গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

নীহাররঞ্জন চক্রবর্তী

দাঁড়া রে বিবেক


‘’দেখুন,সুভাষবাবু । ছেলেরা কেমন থালা হাতে খাওয়ার জন্য ছুটে যাচ্ছে । অথচ লেখাপড়ার নামটি নেই । বেশ মজা,তাই না ?’’ 
টিফিনের পর বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেরা মিড-ডে মিলের খাবার খেতে তাদের গন্তব্যে ছুটে যেতে দেখে ভূগোলের শিক্ষক রঞ্জনবাবু কথাগুলো বলে গেলেন হেসে-হেসে বাংলার শিক্ষক সুভাষবাবুকে । 
তার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সুভাষবাবু । তার দিকে অপলকে হাঁ করে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন ।
পরে বললেন,’’বলেন কী,মশায় ? একথা বুঝি আমাদের মুখে মানায় ? মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা কি ছেলেরা করেছে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য ? নাকি তাদের অভিভাবকরা ? দয়া করে একজন শিক্ষক হয়ে এমন কথা বলবেন না ।‘’ 
 সুভাষবাবুর কথা শুনে তখন রঞ্জনবাবুর ঠোঁটের কোণে তখন ব্যঙ্গের হাসি ।
তিনি বললেন,’’এক বর্ণও আমি বাজে কথা বলিনি । পড়াশোনা লাটে গেছে এই মিড-ডে মিলের জন্য । সরকারের এ নিয়ে ভাবা উচিৎ ছিল ।‘’
রঞ্জনবাবুর কথার কি উত্তর দেবেন,তা নিয়ে সুভাষবাবু তখন গভীরভাবে ভাবতে থাকলেন । মাঝেমাঝে খোলা জানলা দিয়ে দরিদ্র-হতদরিদ্র ছেলেদের হাতে থালা নিয়ে ছোটাও দেখলেন । রঞ্জনবাবু তখন অন্য গল্প শুরু করলেন অন্য দুজন সতীর্থদের সঙ্গে । 
মিনিট দশেক পরে সুভাষবাবু বেশ বলিষ্ঠ-কণ্ঠে বলে উঠলেন,’’মিড-ডে মিল একদম ঠিক আছে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত । কিন্তু সরকারের ভুল কোথায় ? ভুলটা হল,কোনোদিন দেখা-বোঝার চেষ্টা করলো না মাসের শেষে যাদের হাতে কড়কড়ে গোছা-গোছা টাকা তুলে দেয়,তারা তাদের কাজ ঠিকঠাক করছে তো ? কেন শিক্ষককে বলতে হয় ছেলেরা পড়াশোনা করে না ? শুধু খেতে আসে ছেলেরা ?’’
এতগুলো কথাগুলো বলে সুভাষবাবু সারা মুখে বিষণ্ণতা নিয়ে আনমনাভাবে তাকিয়ে থাকলেন খোলা জানলার দিকে । ততক্ষণে দেবশিশু সেবা শুরু হয়ে গেছে । কিছু শিক্ষকের ঝাঁ-চকচকে বাইক তখন তার শুধু চোখে পড়ছে ।
সেদিকে তাকানোর পর সুভাষবাবু অদ্ভুত হাসি হাসতে হাসতে আবার সামনের দিকে তাকালেন । 
 তারপর তিনি বললেন তাদের,’’আসলে ওই বাইকগুলোতে চাপা পড়ে যায় ছেলেদের পড়াশোনা । ছেলেরা ভাবে শিক্ষক নয় তো,সব বাবু । বাবুরা আবার আমাদের কী পড়াবে ? আর সত্যিই বাইকধারী বাবুদের কি পড়াতে ইচ্ছা হয় ?’’ 
তার কথা শুনে রঞ্জনবাবু সহ দুই শিক্ষকের চক্ষু তখন চড়কগাছ । তাদের মুখ-জুড়ে বিতৃষ্ণা । সুভাষবাবু বিলক্ষণ তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন তখন ।
হেসে-হেসে বললেন তাদের,’’চক্ষু চড়কগাছ থেকে নামিয়ে একটু ভাবুন । এখনো সময় আছে । মিড-মিলের পাশাপাশি থাকুক না আমাদের উজার করে শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা ? তা বুঝি হওয়ার নয় । মিছেই বলে গেলাম । সরকারের হাতে শাসনের পেলব চাবুক থাকা দরকার । নইলে আর কি । ক্লাস আছে এরপর । আসি ।‘’
সুভাষবাবু চলে যাওয়ার পর রঞ্জনবাবু রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,’’হিংসা আর হিংসা । লোকটা হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরল । তাই এখনো কিছু করতে পারলো না । ঘরে দুটো বিয়ে-যুগ্যি মেয়ে । কাঠ-ফাটা এক বেকার ছেলে । কি আর হবে ।‘’
আগে সুভাষবাবুর আর পরে রঞ্জনবাবুর কথাগুলো গালে হাত দিয়ে খুব মন দিয়ে শুনছিলেন কর্মশিক্ষার শিক্ষক বসন্তবাবু । তিনি বসেছিলেন অন্যদিকে । তবে সব স্পষ্ট শুনেছেন  
সে বেশ জোরে হেসে উঠে বলে বসলেন,’’আমি অন্তত আমার দিক থেকে বলতে পারি আমাকে পড়াতে হয় না । কচিদের কিছু ক্লাস নিই । আর কর্মশিক্ষার নামে মিথ্যে শিক্ষা দিই । নিজে কি আর কিছু বানাতে পারি ? মাইনেটা কিন্তু’’
তাকেচোপবলে চমকে দিয়ে থামিয়ে দিলেন সেই রঞ্জনবাবু । যার ব্যথায় বুক ফেটে যায় ভাবলে,ছেলেরা পড়ার বদলে শুধু গিলছে । গিলছে তো গিলছেই । তবে কিছু বড় ক্লাসের ছেলেরাও আসছিলো তখন স্টাফ-রুমের দিকে ।