গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

উত্তম বিশ্বাস

লাঠির ভবিষ্যৎ


মারাত্মকরকম মাথার চোট নিয়ে হাওড়া সদর হাসপাতালে ভর্তি হলেন সরোজবাবু। ডাক্তার লিখেছেন, “ইন্টারনাল হ্যামারেজ! বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না!যেহেতু উনি কোন পার্টি করেন, সেটা খুব একটা ক্লিয়ার না; তাই এমন সময় দলের কাউকেই ওঁর পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল না। আর সব আক্রান্তদের সাথে ছোট বড় মাঝারি নেতা-নেত্রীরা কুশল সংবাদ নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সরোজবাবুর স্ত্রী প্রভা দেবী ছাড়া, ওনার পাশে কেউ নেই। মাঝে খানিক হুঁশ ফিরেছিল; সেই সুজগে সুপার রাউণ্ডে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন,--“এভাবে আপনাকে কে পেটালেন?’’ সুপারের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই যন্ত্রণাকাতর জবাব—“খোকা!’’
মাঝে মাঝে মানবধিকার সংগঠনের কর্মীরা এসে মেঝেয় পড়ে থাকা পেশেন্ট পার্টিদের নিয়ে অসম্ভব বাড়াবাড়ি করেন। ওঁরাও প্রশ্ন করলেন যথাপূর্ব; কিন্তু সরোজবাবুর কণ্ঠনালীতে সেই একটি বাক্যই উৎসারিত হচ্ছে, জ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে—“খোকা!’’   

--সারাজীবন এতকিছু করলাম, আর আজ এই সামান্য কাজটুকু করতে পারব না কী বল প্রভা?”
প্রভা দেবী সরোজবাবুর কথায় কোনও উচ্চবাচ্চ না করে, কয়েক টুকরো ঝামা ইট কুড়িয়ে ওঁর হাতে এগিয়ে দিলেন। ইটের কুচিগুলো পাঞ্জাবির পকেটে পুরতে পুরতে পুরোনো কফের মত আক্ষেপ আবারও ঠেলে উঠল সরোজবাবুর গলায়,--“ছেলেটা সেই হাদাই রয়ে গেল! সামান্য একখানা ফাইবারের লাঠি, তাও যদি ঠিকমত নাচাতে না পারিস, তোর উন্নতি হবে কী করে বল! রোজ রোজ কী আর রোদ গরম ঠেঙিয়ে মানুষ নবান্ন অভিযানে যাবে! কেন হাতের কাছে মানুষ কুকুর মিডিয়া মানবধিকার যাকেই পাস, আগেই তুলোধুনা ধুনে দে! তারপর দ্যাখ তোর প্রোমোশান কে আটকায়!
প্রভা দেবী অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন,--“পুলিশের চাকরিটা তো তুমিই করলে পারতে! নিজের অক্ষমতা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দাও কোন লজ্জায়? দুমুঠো ভাতের লোভে মানুষ যে এভাবে নরকে নেমে যেতে পারে তা তোমাকে না দেখলে বিশ্বাসই হত না!
--
ওর ভাতের প্রত্যাশা আমি করি নে। আমি চাই এই কেঁচোর খোলস ছেড়ে ও বেরিয়ে আসুক।‘’
আর আধিক বাক্যব্যয় করলে লরি পাওয়া যাবে না। বুড়ো বটতলায় ড্রাইভার ঘন ঘন হর্ন বাজাচ্ছে। সরোজবাবু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কালবারটের ওপর দাঁড়িয়ে অনভ্যস্ত ছন্দে সোল্লাসে শ্লোগান দিয়ে নিলেন বেশ কয়েকবার—“ইন কিলাব! ইন কিলাব! ইন কিলাব---জিন্দা---!!এই আবেগমথিত শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে হতে কালবারটের জলে তরঙ্গ খেলিয়ে এক্কেবারে কচি অশ্বথ পাতায় শত করতলে অভিনন্দিত হতে লাগল! উৎসাহী জনতার বেশ কয়েক জোড়া হাত এগিয়ে এল সরোজবাবুর দিকে। বৃদ্ধ সরোজবাবু খুব সহজেই লরির খোলে দাঁড়ানো মানুষের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিলেন!

মেয়ো রোড ধরে এগিয়ে চলেছে মিছিল। হোসপাইপের মুখে ফুঁসতে ফুঁসতে উড়ে আসছে ধারালো জলের কুচি। চশমার কাঁচের ওপর যেন আকস্মিক শিলাবর্ষণ হতে লাগল। হাত শূন্য ইয়াং জেনারেশানের দল সরোজবাবুকে কর্নেলের মর্যাদা দিয়ে আগলে নিয়ে চলেছে সামনের সারিতে। অনেকে লঙ্কার গুড়ো খেয়ে আক্রোশে মরিয়া হয়ে এগিয়ে আসে সরোজবাবুর কাছে,--“কাকু পকেটের ওই ইটের টুকরোগুলো আমাদের দেন; ওসব আপনার দ্বারা সম্ভব না!সরোজবাবু কোনও তোয়াক্কাই করলেন না; বরং বীরের ভঙ্গিতে এগোতে লাগলেন ব্যারিকেডের দিকে! সাদা পোশাক আর সাদা সাদা হেলমেটে ঢেকে আছে আস্ত একটি শহর! সেখানে অভীক কোথায়!? ঝিল্লির পাখার মত তিরতির করে কাঁপছে জৈষ্ঠ্যের চাঁদি ফাটা রোদ!  লাঠি হেলমেট আর আবক্ষ ঢালের আড়ালে নিরীহ অভীক সরকারকে এখন আলাদা করাই মুশলিল! এবার সরোজবাবু একদম মরিয়া হয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন,--“এক বাপের বেটা হবি তো সামনে আয় অভীক! কাপুরুষ কনস্টেবলের বাচ্চা কনস্টেবল! আজ তোর মাথা ফাটিয়েই ছাড়ব!

প্রভা দেবী হাসপাতালের মেঝেয় পড়ে থাকা সরোজবাবুর মাথার কাছে বসে বসে, একটি স্বল্প প্রচারিত দৈনিকের এডিটরকে এইসব বয়ান দিচ্ছিলেন। এমন সময় ফোন,--“হ্যালো মা! আমি অভীক! আমি ভালো আছি। হ্যালো? হ্যালো? এতো শাউটিং কেন? কোথায় তোমরা?” হাজার চিৎকার চেঁচামেচি কাতরানির কোপে ছেলের কথাগুলি শোনাই যাচ্ছিল না। অগত্যা লাউডস্পিকারে দিলেন,--“হ্যা মা! এবার শুনতে পাচ্ছো? আমি অভীক বলছি। আমি টোটালি সেভ আছি। কোনও সমস্যা হয় নি। কাল আমার পজিশান ছিল ফোরথ ব্যারিকেডে--- আই মিন একদম সেফ জোনে। আর হ্যাঁ, আমি তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি! আননেসেসারি কাউকেই হিট করিনি! 
--একটু বাড়ি আয় খোকা!
--
সরি মা! দুদিন পর লালবাজার; তারপর ছুটি! বাপি কোথায়?”
বাবা ডাক শুনে অর্ধ অচেতন সরোজবাবু এবার উঠে বসলেন। রক্তমাখা পাঞ্জাবির ঝুল পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন একটা খুঁজে চলেছেন। ওর অস্থির অবস্থা লক্ষ্য করে প্রভা দেবী ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। মোবাইলটা কান থেকে খসিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললেন,--“কী লাগবে তোমার? এমন করছো কেন? কী হয়েছে তোমার অ্যাঁ---!!
--
পাথর কোথায়? আমার পাথর এনে দাও! এই পকেটে আরও একটা ছিল! দিব্যি মনে আছে! দিব্যি---!!
--
ওগো তুমি শান্ত হও! এই অসুস্থ শরীরে পাথর কি করবে তুমি?”

সরোজবাবুর স্থির নিস্পলক চোখদুটো শেষবারের মত আছড়ে পড়ে, বখাটে মোবাইলটার দিকে!