গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ১৭তম সংখ্যা ১৭ই জুলাই ২০১৭

এই সংখ্যায় ৯টি গল্প । লিখেছেন তাপসকিরণ রায়, অলভ্য ঘোষ, নীহার চক্রবর্তী, শীলা পাল, সুমন মাইতি, মোহম্মদ জাহিদুল ইসলাম, ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী, তন্ময় বসু ও মনোজিত কুমার দাস ।

তাপসকিরণ রায়

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী--

ভিক্টোরিয়া হসপিটালের স্ট্রেচার


জবলপুরের ভিক্টোরিয়া হসপিটাল। রেলওয়ে হসপিটাল। হসপিটাল বলতেই জন্ম মৃত্যুর আখাড়া বলা যায়। জন্মের পরে তো মানুষ বাস্তব জীবনে এসে ওঠে আর অন্যদিকে মৃত্যুর পরে নাকি পরলোকে বাস ঘটে। জন্মের পর বাস্তব জীবনে পরলোকের অভিজ্ঞতা থাকে না। তবু জ্ঞান, ধারণা ও ঘটনা পরম্পরা বিন্যাসে আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি যে পরলোক আছে, জন্ম-জন্মান্তর আছে। এ ব্যাপারে অনেক অনেক ঘটনা ও গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে বা হবে।

যাইহোক যে গল্প বলতে যাচ্ছিলাম তা কিন্তু গল্প হলেও সত্যি।
সব আত্মা, প্রেতাত্মা, বিদেহীরাই এই লোকে অদৃশ্যমান তা  কিন্তু নয়। দেখতে বা শুনতে পাওয়া যায় যে কিছু আত্মারা নাকি পৃথিবীর অগাধ মোহমায়া ছেড়ে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে না বা চায় না। সে সব আত্মারা  তীব্র ইচ্ছের ফলে মানুষকে দেখা দেয় বা দেখা দিতে পারে। আর দেখা দেওয়াটাই তাদের অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ নয়, তারা তাদের সক্রিয়তার প্রমাণ দিয়ে চলে অর্থাৎ তারা এ লোকে নিজেদের অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করতেও সচেষ্ট থাকে।

এই ভিক্টোরিয়া হসপিটালেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছিলো। রাত বারটার পর থেকে জেগে ওঠে সে বিদেহী আত্মা। আর জেগে উঠেই সে শুরু করে তার নিয়মিত ডিউটি। রাতের শান্তটা ভেঙে হঠাৎ ঠুকঠাক খুটখাট স্ট্রেচার নাড়াচাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। এখানকার নার্স, ডাক্তার ও পেসেন্টরা ওই নিশুতিতে যারা জেগে থাকে তারা দেখে ও শোনে সেই শব্দ--কোন পেশেন্টকে নিয়ে আসার জন্যে কেউ যেন স্ট্রেচার ঠেলে হসপিটালের গেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। না কাউকে দেখা যায় না--কোন ছায়া, ছায়াদেহ বা কোন অশরীরী ছাপ সেখানে পাওয়া যায় না--শুধু খালি স্ট্রেচার চলছেআবার ফিরে আসছে স্ট্রেচার, তাতে যেন কোন রোগী শায়িত আছে ! তৎপরতার সঙ্গে সেটা কোন খালি বেডের কাছে যাচ্ছে। ঘট ঘটাং শব্দ হয়ে স্ট্রেচার এদিক ওদিক দুলে উঠছে, মনে হচ্ছে কোন রোগীকে কেউ  খলি বেডে শুইয়ে দিচ্ছে। বিছানায় কোন পেসেন্ট নেই, তবু কোন পেসেন্ট যেন ভর্তি হল। স্ট্রেচার আবার ফিরে এলো তার নিয়ম মাফিক বিশ্রামের জাগায়।

এ ঘটনা ঘণ্টা খানেকের জন্যে প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে। কারো চোখে কিন্তু অন্য কিছুই পড়ছে না--কেবল খলি স্ট্রেচারের সময় ও নিয়ম মাফিক আনাগোনা অনেকেই দেখছে। এ এখন হসপিটালের নিত্যদিনের এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে।  কখনও নার্সের পাশ দিয়ে স্ট্রেচার চলে যাচ্ছে--হয়ত নার্স তাকে নিজের মত করে যেতে দিচ্ছে। কখনও ডাক্তার ভীত হয়ে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্ট্রেচারের যাওয়া আসা দেখছেন। জেগে থাকা রোগীরা ভয়ে জড়সড় হয়ে আড় চোখ নিয়ে দেখে যাচ্ছে সে দৃশ্য। একবার ভুল বশত: একজন স্ট্রেচারের সামনা সামনি হয়ে পড়েছিল। ভীত লোকটা থ মেরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, সে সময় স্ট্রেচার আপনি আপনি থেমে গিয়েছিলো, মুহূর্ত পরেই সেটা সেই লোকটাকে পাশ কাটিয়ে নিজের গতিপথ পালটিয়ে চলে গিয়েছিল।

সংবাদ পত্রে এ ঘটনা এসেছে। এ ঘটনার একটা ভিডিও তৈরি হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে, সে স্ট্রেচার যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। স্ট্রেচার শেষ পর্যন্ত রোগীর খালি বেডের কাছে গিয়ে কিছুটা ওপর নিচে হয়ে আবার ফিরে এসে নির্দিষ্ট রাখার স্থানে এসে নিশ্চল পড়ে থাকছে।
                                                                     
         

অলভ্য ঘোষ

চোর

আমি শুধু একটু সময় চুরি করেছি।মনের দুটো কথা কলমের আঁচড়ে শব্দর বুননে খাতায় আঁকব বলে।মল্লিকা আমায় সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে বলে। কোন একটা বিষয় পেলে আমি নাকি না কচলে ছাড়ি না। এ সবই আমার রোগ। অপদার্থ ঠাওরায় আমাকে ও আমার সাহিত্যকে। কখনও ছাপা হয়নি কিনা। এটুকু বোঝে না সব লেখকই কোন না কোন সময় অনাবিষ্কৃত ছিল।এমন ভাবে শুয়ে বিছানার পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে আমি লিখি; মল্লিকা ঘুমালে।

আঃ! ঘুম পেয়ে গেল; কটা বাজে? বাবা.....দুটো!

"দিন যায়.......ক্ষণ যায়........সময় কাহারো নয় বেগে ধায় নাহি রহে স্থির, সহায় সম্পদ বল, সকলি ঘুচায় কাল আয়ু যেন শৈবালের নীর!"
কার লেখা? ধুর ছাই কোন ছোটবেলায় পড়েছি মনে থাকে। মল্লিকাকে জিজ্ঞাসা করি;মল্লিকা এই মল্লিকা;সত্যি বাবা ঘুমাতে পারে;মেয়ে কুম্ভকর্ণ।

একি বিছানায় মল্লিকা নেই ? এত রাতে আবার গেল কোথায় ?

আগে একটা সিগারেট ধরাই তারপর দেখেছি।সিগারেটের প্যাকেট টা আবার কোথায় গেল;এইতো বালিশের তলায় রেখেছিলাম।এখন দেখছি সিগারেট লাইটার কোনো কিছুই নেই। আঃ জিনিসপত্র সব যায় কোথায় কে জানে।আচ্ছা মল্লিকা কি মেয়ের কাছে ? দেখি যাই.....

কাণ্ড দেখেছো;বই খোলা;আলো জ্বলছে;মেয়েটা দরজা ভেজিয়ে ঘুমাচ্ছে।মেয়েটা হয়েছে মায়ের মত........ঘুমকাতুরে;আরে বাবা ঘুম পেয়েছে তো ঘুমা;বই বন্ধ কর....লাইট অফ কর। এদিকে ইলেকট্রিকের বিল দিতে দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত।কদিন অন্তর অন্তর দেখি ঐ মোড়ের মাথায় একদল লোক চোঙা ফোঁকে;বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজকের সমাবেশ সফল করে তুলুন।তারপর কাগজে ধরে বেঁধে জনগণের স্বাক্ষর।পাশ কাটিয়ে যে পালাতে না পারে তিক্ততার ভঙ্গিতে একটু কলম নেড়ে দেয়।হ্যাঁ চোঙা ফুঁকতে ফুঁকতে যখন গলা চিরে যায়;জিভ শুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসে;রাস্তার কলের দুই ঢোক জল খেয়ে চোঙা খুলে বাড়ি গিয়ে ঘুমায়।মনে মনে ভাবে ভিমরুলে কামড়ে ছিল নাকি;এই মরার দেশে প্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওদিকে ফলাও করে নিয়মিত টিভিতে উঁকি দেয় বিজ্ঞাপন। বিদ্যুৎ চুরি দণ্ডনীয় অপরাধ।পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা এমনকি পাঁচ বছরের জেল অবধি হতে পারে।হুকিং এর অভিযোগে এই তো আমাদের ফ্লাটের সামনের বস্তি থেকে টিভি, পাখা খুলে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। কয়েকজন কে ধরেও নিয়ে গিয়েছে নাকি।তবে এই সব হুড়কোর ব্যবস্থা শুধুমাত্র চুনোপুঁটি দের জন্য।রাঘববোয়ালরা সত্যিই কি জালে ধরা পড়ে? আর ধরা পড়লেও পুঁটি মাছের নরম সুতোর জলে তাদের ধরে রাখার ক্ষমতা নেই।যাকগে.... এখনকার সোজা সমীকরণ হল; দেখ, শোন, কিন্তু, বোঝার চেষ্টা টি বাপু করোনা।তাহলে কপালে কালী নাচবে।বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে কূল কিনারা করতে পারছি না.....তা আবার ......এই করে করেই তো দেশটা গেল;সব শালা আমার মত আখেরটা ভাবে।সমাজে থাকব অথচ সমাজ সংস্করণ করব না।ধরি মাছ না ছুঁই জল।যে ঘরে থাক সে ঘরটা ঝাঁট না পড়লে ধুলো এসে জমবেই বাবা।জমছে কারো হুঁশ নেই।

এই আমার একটা দোষ; বড্ড পেঁচাল পাড়ি।

কি চলছে মোবাইলে ওটা?

পর্নোগ্রাফি !!

শ্রেয়া তুই ......!

অনেক বড়----হয়ে গেছে। আজকালকার ছেলে মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়!তাই না। টিভিতে কাঁটা লাগা সর্বদাই চ্যানেল ঘুরলেই। দেহ দেখিয়ে ব্যবসা। বাপ ছেলে মেয়ে একসাথে বসে দেখার দিন নেই।এম টিভি, জিটিভি চোখ মেলে রয়েছে মাথাগুলো চিবোবে বলে।বুঝতে পারি ওদের নেশায় আচ্ছন্ন করা হচ্ছে। ....পত্র পত্রিকায়, পোস্টারে পার্কে, বাসে-ট্রামে, ঘরে বাইরে সর্বত্র রয়েছে এই দেহাত্মবাদের পসরা সাজানো।শিক্ষা? শিক্ষা এদের এতই দুর্বল যে বর্ম হতে পারে না। শ্রেয়ার মত ছেলে মেয়ে গুলোকে তাই আগুনের শিকার হতে হয়েছে।ওরা তো পতঙ্গের মত। আগুনের আলোতে উৎফুল্ল হয়ে ছুটে আসে। বোঝে না আগুনের তাপে ঝলসে যাবে;কিন্তু যারা বিষ ছড়াচ্ছে;চুরি করে নিতে চাইছে তারুণ্য...উদ্দামতা.... সুস্থ জীবনটাকে বিকৃত করে দিতে চাইছে; সেই সব চোর গুলোকে আমরা কি চিনি না।চিনতে পারি না।একটি অসভ্যতার বিষ আমাদের শিরা ধমনী বেয়ে উঠে চলছে দিন দিন;আর সেই বিষ.....

আবার হিমালয় প্রমাণ ভাবতে বসলাম।এই আমার এক বড় বদ অভ্যাস।সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে একদম হয়ে ওঠে না। আসলে জীবনের প্রতিটি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের মত এত কথা জ্বলে ওঠে;যে থেমে যেতে হয়।চেপে ধরে কথাগুলো;বিরক্ত লাগে তবু মেনে নিতে হয় এই স্তব্ধতা কে।যেমন একটু আগে চেপে ধরেছিল শ্রেয়ার লুকিয়ে লুকিয়ে বাজে ছবি দেখা; আচ্ছা এটাও তো চুরি বলতে পারি?চুরি করে দেখা। আমি যেন একটা কি! আসলে অফিসে আমার ইম্পরট্যান্ট ফাইলটি চুরি যাবার পর থেকে সকলকে কেমন যেন চোর চোর মনে হচ্ছে; নিজেকেও।ফাইল টা গায়েব করা হল।"ইট হ্যাভ ইনক্লুডে-ড লাস্ট টেন্ মান্থস জোন ওয়াইস সেলস রিপোর্ট।"কাজটা যে আমাদের মালিকই করছে সেটা আমরা সবাই জানি। কোম্পানির অডিটর থেকে মাছি মারা কেরানিটি পর্যন্ত। কিন্তু কারো মুখ খোলার উপায় নেই।সকলে বোবা হয়ে গিয়েছে।মালিকের সোজা কথা ;" যাদা হুঁশিয়ারি মত দেখাও।ফল খাও পেড় মাত গুনো।"আর এই ফল খেতে খেতে আমরা ফলিয়ে উঠছি।বাড়িতে ছেলে মেয়ে বউকে ফাঁকি।সব কাজ সামলে তাদের সময় দিতে পারিনা।পার্ট টাইমার হিসেবে আরও দু জায়গায় হিসাবের খাতা দেখতে হয়। মানি মোর মানি। কি অসম্ভব নেশা।ড্রাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কি পাচ্ছি;না পাচ্ছি তলিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। জীবনের চাহিদা গুলো অনন্ত দিগন্তের মতো সুদূর প্রসারী হয়ে উঠেছে।জীবনভর আস্ফালন করে চলেছি টাকার পিছনে।

আজকাল আরো একটা নেশা চেপেছে মদ্যপানের।হালফ্যাশনের বাবু হওয়ার ঝোঁকে; না মানসিক শান্তির প্রচেষ্টায়;ঠিক বলতে পারব না। মাঝে মাঝে পার্টিতে একটু আধটু চোনায় গলা ভেজাই।কখনো কখনো রাতে দরজা বন্ধ করে বোতল খুলি। মল্লিকা বলে গুণ তোমার বাড়ছে দিন দিন।অথচ এই আমি একদিন মদ্যপানের ঘোর বিরোধী ছিলাম।মানুষ কত পাল্টে যায় তাই না?এখন একটা যুক্তি খাড়া করেছি মনে মনে;হুইচ ডু, হোয়েন ডু, হোয়ার ডু, হোয়াই ডু, এই কথাগুলো মাথায় রেখে খেলে কোন দোষ নেই।দেবতারাও তো সোমরস খেতেন।

মল্লিকা বলে;তারা তো আর কিছু করতো উর্বশী...মেনকার সাথে ফষ্টিনষ্টি....সেগুলোও করো।

মানে মদ্যপান টিকে সামাজীকরণ করে নিয়েছি।বাইবেলের কোন পৃষ্ঠায় যেন দেখেছিলাম মদকে ওষুধের মত গ্রহণ করলে অধর্মাচরণ হয় না।মানে বলতে চাইছি সংস্করণে অতি গর্হিত বস্তু বা ব্যক্তি সমাজের চোখে অনাচার থেকে আচারে পরিণত হয়।যেমন; হিন্দুত্বের পুন: প্রতিষ্ঠা।ঐ যে কোন একটা দল ধরে ধরে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষ গুলোকে পুনরায় সনাতন হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনছে না!সাধারণ মানুষ হল জলের মত;যখন যে পাত্রে রাখবে তার আকার ধারণ করবে।মুঘল আমলে মুসলিম,ব্রিটিশ আমলে খ্রিষ্টান।আর এই আমলে.... ?

থুড়ি!সেকিউল্যার কান্ট্রি !ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।মধ্য কথা টা চুপি চুপি বলি জোর যার মুল্লুক তার।দেখছেন না পৃথিবীর উপর মার্কিনী ছড়ি ঘোরানো; সাদ্দামের বিচার করবে তারা।রাষ্ট্রসংঘ?তুড়িতে উড়ে যাবে।

এই আমার একটা দোষ অহেতুক পেঁচাল পাড়ি বড্ড। মল্লিকা তাহলে নিশ্চয়ই বুবুনের ঘরে;বুবুনের ঘুম আসছে না বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আলোটা নিভিয়ে দিই।

এ ঘরতো অন্ধকার তাহলে কি মল্লিকা বুবুনের কাছে আসেনি?গেল কোথায় ?

সিগারেটের গন্ধ বেরচ্ছে না?এই তো টেবিলের উপর অ্যাস্ট্রেতে ধোঁয়া উড়ছে।এই তো সিগারেটের প্যাকেট টা, এইতো মিউজিকাল লাইটার।বুবুন আজকাল!

না বলে অপরের জিনিস নেওয়া তো চুরি;এর কোন দ্বিমত নেই।উঃ!একটা সিগারেট ধরাই।লাইটারের এই মিউজিক টা আমার খুব ভালো লাগে।কিন্তু মল্লিকা কোথায় গেল; তবে কি ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে;ঘুম আসছে না বলে। দেখি।

ঐ তো ব্যালকনির রেলিং-এ ভর দিয়ে মল্লিকা দাঁড়িয়ে।হাতে একটা বাঁধানো ছবি না!বেডরুমে রাখা আমাদের বিয়ের ছবিটি?আজ কত তারিখ ?আমাদের বিয়ের দিন নাকি আজ?না!সে তো কনকনে ঠাণ্ডার সময়।অফিসে সাইন করার সময় ডেট টা কত লিখেছিলাম;কি বার আজ? বুধবার।সোমবার কুড়ি তারিখ ছিল আজ বাইশে জুলাই; মাথার ভেতর টা ধপ ধপ করছে;চোখ দুটো কালো ছোট ছোট বিন্দুতে ভরে গিয়েছে।দূরদর্শনের বিদ্যুৎ হানি হলে যেমন হয় আমাদের টিভি স্ক্রিনে।

বাহাত্তর সাল; অশান্ত আবর্ত সঙ্কুল সময়;প্রেসিডেন্সি কলেজ;বি.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র অনিরুদ্ধ;আমি আর মল্লিকা।কলেজ দাপিয়ে বেড়াতাম তিনজনে। অনিরুদ্ধ ওয়াজ জিনিয়াস;যেমন গানের গলা;তেমন লেখার হাত; আবার ফুটবলের মাঠে অনিরুদ্ধই ছিল আমাদের স্কোরার।মল্লিকা বলত সারাজীবন তোমাকে হাঁদার মতন গোলেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।অনিরুদ্ধ যখন একটার পর একটা গোল করে টিম কে এগিয়ে নিয়ে যেত;আমি বুক পেতে গোল আটকাতাম।মল্লিকার কথায় আমার রাগ হতো না।কারণ শত জন্মে আমি অনিরুদ্ধ হতে পারবো না।মল্লিকার সঙ্গে অনিরুদ্ধর ভালবাসা ছিল;শ্রেয়া এসে পড়েছিল পেটে।বাইশে জুলাই রাত একটায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় অনিরুদ্ধ।

আচ্ছা অনিরুদ্ধর মল্লিকাকে আমি চুরি করিনি তো ওকে জোর করে বিয়ে করে?কিন্তু এ ছাড়া আর কোন পথ ছিল না;মল্লিকা সুইসাইড করতে গিয়েছিল।ওর হাতের ছবিটা অনিরুদ্ধর।মাসখানেক আগে আমি কলেজ স্ট্রিট থেকে বাঁধাই করে এনে দিয়েছি।

মল্লিকা আজ ও অনিরুদ্ধ কে ভোলেনি।এমন করে আমার বুকে মুখ গুঁজে আর কত রাত মল্লিকা অনিরুদ্ধর কথা ভেবেছে। তবে কি আমার ভালবাসা চুরি করে মল্লিকা অনিরুদ্ধকে ভালবাসে?আজ আমার কেন যেন হিংসে হচ্ছে অনিরুদ্ধ কে;রাগ হচ্ছে মল্লিকার উপর;মল্লিকা ও চোর; চোর মল্লিকা!

রাতের কথাগুলো প্রায় ভুলেই বসেছিলাম।খবরের কাগজ খুলেই দেখি আমাদের শিল্পমন্ত্রীর ছবি।জগন্নাথ মিত্র। জগাদা; আজকের সরকারের মন্ত্রী।অথচ এই জগাদা আমাদের কত মন্ত্রণা দিত লড়াইয়ের।যাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতো মিছিলে আজ তাদের সাথেই হাত মিলিয়েছে। ক্যানসারের মতো পচে যাওয়া সুবিধাবাদীর রাজনীতির স্তূপের উপর মন্ত্রী হয়ে দাঁড়িয়েছে।কি সহজেই ভোল পাল্টে যায়;গিরগিটির মত বদলে যাই আমরা।সবকিছু কে ধান্দা বানিয়ে নিই।দেশ, জাতি, মা, বাবা, বন্ধু, প্রেমিকা, সব সবকিছুকেই।

আমাদের সাউথ জোনের অফিস উদ্বোধনের সময় জগাদা এসেছিলেন অতিথি হিসেবে।যেচে কথা বললাম।মাথায় টাক পড়েছে; চেহারায় বেশ চাকচিক্য এসেছে।আগে তো একটা বিড়ি দুটান অর্ধেক নিভিয়ে রেখে খেত।কোন একটা ম্যাগাজিনে দেখেছিলাম কণিকা দিকে বিয়ে করেছে।বিয়েটা ও ধান্দা; যুব নেত্রী হিসাবে কণিকাদির জগাদার চাইতে জনপ্রিয়তা ছিল বেশি;সেটাকে কাজে লাগিয়ে ভোট বাড়িয়েছে আর কি।আমাকে দেখে এমন একটা ভাব করল যেন ভুত দেখেছে।অনিরুদ্ধর কথা বলায় বলল; কোন অনিরুদ্ধ ?যাদের লাশ কে সিঁড়ি করে আজকের গদিতে চড়ে বসলে তাদেরকে ভুলে গেলে?সব শালা চোর......চিটিংবাজ।

আচ্ছা এভাবে কেন ভাবতে পারছি না;আমি যেমন আত্মতুষ্টির জন্য চুরি করে লিখি ঠিক তেমনি আত্ম সন্তুষ্টির জন্যই অগরওয়াল সাহেব অফিসে ফাইল সরিয়ে ফেলে;শ্রেয়া লুকিয়ে লুকিয়ে বাজে ছবি দেখে;বুবুন সকলের অলক্ষ্যে সিগারেট খায়; মল্লিকা আজও অনিরুদ্ধকেই ভালবাসে।জগদা অনিরুদ্ধর প্রাণ চুরি করে আদর্শের মুখোশ পরে মন্ত্রী হয়ে বসে। এ সবই আত্মতুষ্টির জন্য; আত্মার জন্য?নাকি ভোগ সর্বস্ব দেহটার জন্য?আহার, নিদ্রা আর মৈথুন যার মূল ব্রত।কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য ছটি রিপুর তাড়নায় যে প্রতিনিয়ত ছটফট করছে।

শুধু আবদ্ধতা। আর আবদ্ধতা?কিন্তু আত্মা মুক্ত; তার কোন আবদ্ধতা নেই।সে সৎ, চোর জোচ্চোর নয়; তাই না?



নীহার চক্রবর্তী

প্রেমানল জ্বলিয়াছে 


''জাবেদা তুই আমাকে এড়িয়ে যাবি না কখনো সে আমি জানি । আমি তোকে চিনে গেছি । বুঝে গেছি তোর ভেতরে দিনে-দিনে আমার জন্য একটা প্রেমের সাগর তৈরি হয়েছে ।''
প্রমোদ এক-মুখ হেসে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো । জাবেদা শুনে অনিন্দ্য-সুন্দর হাসি হাসল । 
পরে বলল,''আমিও তোকে বুঝি রে । আমার জন্য তোর মধ্যে একটা প্রেমার্ণব গড়ে উঠেছে । কিন্তু সমস্যা তো তুই জানিস সব ।''
জাবেদার কথা শুনে প্রমোদ চুপ করে কীসব ভাবতে থাকলো তখন ।
বেশ কিছু পরে ও মুখ খুলল । 
বলল অস্ফুট-গলায়,''সে আমি খুব বুঝিতোর বাবা হিন্দু মানেই বোঝে শত্রু । আমার বাবাও মুসলমানদের শত্রু বলে ভাবে । আসলেই কি তাই ? ঈশ্বর কি আমাদের হিন্দু-মুসলমান করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ? আর প্রেমের কাছে সব তুচ্ছ । তাই না ? দেখিস আমাদের মনের জোর থাকলে সব বাধা পেরিয়ে যাবো একদিন । তুই শুধু ভয় পাস নারে ।''
প্রমোদের কথাগুলো শুনে তখন জাবেদার মুখে হাসি ফুটল ।
হেসে উত্তর দিলো,''বেশ । ভয় পেলাম না । তবে তুই দায়িত্ব নে আমার মেজাজি বাবাকে ম্যানেজ করার ।'' 
জাবেদার কথা শোনার পর স্মিত হেসে প্রমোদ বলল,''আমার বাবাকে আমি ম্যানেজ করতে পারবো না । সে একদম বোঝার মানুষ নয় । দেখি কাকুর সঙ্গে কথা বলে । আমাকে কিন্তু একটু হলেও ভালোবাসে । তাই নারে ?''
জাবেদা তখন প্রমোদের কথা শুনে অম্লান হেসে বলে,''সে আমি জানি । তবে দেখ । তবে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে হিন্দুদের মধ্যে । যা করার এখুনি কর ।''

তার দু-একদিন পর প্রমোদের পাশের বাড়ির বংশী হালদার বলল প্রমোদের বাবাকে,''দাদা,এ দেশ ছেড়ে আমরা চললাম । এ দেশ আর আমাদের নয় বুঝে গেছি । সামান্য দামে কেদার মোল্লার হাতে বাড়ি তুল দিচ্ছি । আগামী পরশু আমরা পশ্চিমবঙ্গে চললাম । জানি না কি আছে কপালে আমাদের ।''
পাশের ঘর থেকে সব শুনল প্রমোদ শুনে বেশ আতঙ্কিত হল । বেরিয়ে এলো ঘর থেকে ।
ও বংশী হালদারকে বলল,''এভাবে তো দিনে-দিনে অনেকেই চলে যাবে । তাই না ? জানি না আমরা কি করবো ।''
প্রমোদের বাবা শুনে মাথা নিচু করে বসে থাকলো খানিকক্ষণ । মুখ তুললে তাকে খুব উদাসী দেখাল । চোখের কোণে তার জল চিকচিক করছে । বংশী হালদারের চোখেও জল ।
প্রমোদ সইতে না পেরে আবার ঘরে ঢুকে জাবেদাকে ফোন করলো । জাবেদা একটু অবাক হল শুরুতেই ওর থমথমে গলা শুনে ।
জাবেদা প্রমোদের সব কথা শোনার পর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,''জানি না কি হচ্ছে । এ আমার মাথায় আসে না। মুক্তিযুদ্ধ তো আমরা একসাথেই করেছিলাম । তবে আজ ভাগাভাগি কেন ? তোমরা কিন্তু ঠিক থেকো । আমাকে ভালো যদি বেসেই থাকো,তবে এ দেশ ছাড়ার কথা ভেবো না । কেমন ?''
প্রমোদ স্পষ্ট অনুভব করলো জাবেদার কান্না-ভেজা গলা ।
ও তখন অস্ফুট-গলায় বলল,''আমার তো এ দেশ ছাড়ার ইচ্ছে নেই । এখানেই তো চাকরী করছি আমি । ও বাংলায় গেলে ভবিষ্যৎ তো অনিশ্চিত । তাই না ?''
শুনে একটু স্বস্তি পেলো তখন জাবেদা । 
একটুখানি হেসে উত্তর দিলো,''দেখো তবে । ভেঙে পড় না । তোমার বাবাকে বুঝিও ।''
প্রমোদ উত্তর দিলো মধুর হেসে,''আমাদের ইচ্ছের জয় হোক ।''

এর কিছুদিন পর প্রমোদের বাড়ির আশেপাশের আরও দুই হিন্দু-পরিবার তাদের দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলো । বিদায়ের আগে দুই বাড়ির মালিক দেখা করে প্রমোদের বাবার সঙ্গে ।
তাদের একইরকম বক্তব্য,’’এ দেশ আর আমাদের নয়,দাদা । মুসলমানরা ছেয়ে ফেলেছে সব । আমাদের আত্মসম্মান বলে আর কিছু নেই । ভবিষ্যৎ অন্ধকার আমাদের । পারলে আপনিও আমাদের পিছনে আসুন । ভারতে কিছু একটা হবেই ।‘’
তাদের কথা শুনে খুব চিন্তায় পড়ল প্রমোদের বাবা । প্রমোদের সঙ্গে এ নিয়ে একান্তে কথা বলল ।
সারা মুখে বিষণ্ণতা নিয়ে সে বলতে থাকলো,’’শুনলি তো সব । এবার বল আমাদের কি করার আছে । এখানে প্রশাসন বলে কিছু নেই । মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডারের দেশ হয়ে গেছে । বাড়ি বেচেসামান্য় কিছু নগদ পেলেও এ দেশ আমি ছেড়ে দেবো । আমার প্রিয়জনদেরও আমার সঙ্গ নিতে বলবো ।‘’ 
 কথাগুলো বলসে সে একরাশ হতাশা নিয়ে বসে থাকলো ।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রমোদ বলল,’’তা কেন ? আর কিছুদিন আমরা অপেক্ষা করতেই পারি দিন ভালো হতেও পারে । দেখাই যাক না,বাবা ।‘’
কিন্তু পরে একইরকম কথা শোনালো প্রমোদের বাবা । প্রমোদ অসহায়ের মতো তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকলো । সেখান থেকে সরে যাওয়ার পর প্রমোদের চোখে জল ভরে এলো জুনিয়ার ডাক্তার তথা ওর স্বপ্ন-কুঁড়ি জাবেদা খাতুনের জন্য ।

জাবেদাও শত কাজের মাঝে একটু-একটু করে খবর পাচ্ছে চারদিকের । মন তাই ভালো নেই ওর । বারবার ভেবে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে প্রমোদের জন্য । দুজনের চলার পথ বুঝি রুদ্ধ হল এবার ।
এ ভেবে প্রমোদ ফোন করলো ওকে । বাবার মনের কথা সব শোনালো । অনেক হিন্দু যে দেশ ছাড়ছে,সেকথাও জানালো জাবেদাকে সখেদে । 
সব শুনে বলল জাবেদা,’’বুঝি সব । জেনেছি অনেক । কিন্তু এমন হবে কেন ? শেখ মুজিবের দেশের এমন হওয়ার তো কথা নয় । কেন হচ্ছে এমন ? তুমি কিছু জানো, প্রমোদ ?’
প্রমোদ তখন এক চিলতে কষ্টের হাসি হেসে উত্তর দেয়,’’জানলে তো হয়েই যেত । আসলে এ অপশক্তির সুপ্তকামনা । আজ জেগে উঠেছে । এ বুঝি থামার নয় আর । কিন্তু আমার বাবাকে কে ঠেকায় ? কিছুই মাথায় আসছে না আমার,জাবেদা ।‘’
‘’
কিন্তু আমাদের দুজনের চলার পথ কি একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেলো ? সে কি হওয়ার ছিল ? কী ভাবছ তুমি এ নিয়ে বল ।‘’
জাবেদার কান্না-ভেজা কথায় প্রমোদ তখন একেবারে নিরুত্তর । জল-ভরা চোখ নিয়ে ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো শুধু ।
দেখে জাবেদার চোখেও জল এলো । 
কিন্তু ও রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে আশাসূচক স্মিত হাসি হেসে বলল ওকে তখন,’’আর দেরী কর না । আমার বাবার সঙ্গে কথা বল । কাল তোমার ছুটি । চলে এসো আমাদের বাড়িতে ।‘’
জাবেদার কথা শুনে প্রমোদ এক ঝলক হেসে বলে উঠলো,’’আমি কালই যাচ্ছি কাকুর কাছে । মার হাতের তৈরি নাড়ু নিয়ে তৈরি থেকো কিন্তু ।‘’ 
প্রমোদের কথায় জাবেদার সারা মুখে ওর কিশোরী-বেলার হাসি লুটোপুটি খেতে থাকলো ।

''আরে,বলছ কী তুমি,প্রমোদ ? এ বুঝি হয় ? আমরা ভিন্ন ধর্মের মানুষ । তোমরা ভিন্ন ধর্মের মানুষ । মেলে কখনো ? আর আমি সব বুঝে মিলিয়ে দিলেই হল ? আমাকে আস্ত রাখবে আমাদের মানুষরা ? তুমি অন্য চিন্তা কর । এ হয় না ।''
দু'চোখ বিস্ফারিত করে কথাগুলো বলে গেলো জাবেদার বাবা সালাউদ্দিন প্রমোদকে । 
প্রমোদ তার কথায় কিছুটা দমে গেলেও অনাবিল হেসে বলল,''সে আমি কিছুটা হলেও বুঝি,কাকু । কিন্তু আমি যে জাবেদাকে ভালোবাসি । জাবেদাও আমাকে মন-প্রাণ থেকে চার । আমাদের প্রেমের কি কোন মূল্য নেই ?''
পাশের ঘর থেকে জাবেদা সব শুনছে তখন । ওর গাল বেয়ে টপটপ করে জল ঝরেই চলেছে । পাশে বসে ওর মা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে । 
সালাউদ্দিন প্রমোদের কথা শুনে খানিকক্ষণ কিছু ভেবে নিলো । 
পরে বলল,,''দুজন দুজনের বন্ধু ভাবতে পারো । তার চেয়ে বেশী কিছু নয় । বুঝলে ? এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো ।'' 
এরপর প্রমোদ কষ্টের হাসি হেসে তাকে বলল,''ঠিক আছে,কাকু । আমি ভেবে দেখি । তবে আর একটা কথা মনে এলো । বলি ?''
সালাউদ্দিন উদাসভাবে বলল,''বলে ফেলো । তবে ঘর বাঁধার কথা নিশ্চয় না সে ?''

''আমি তো জাবেদাকে নিয়ে বিদেশে চলেই যেতে পারি । তাই না,কাকু ? আমরা শিক্ষিত দুজনেই । যেকোনো দেশে কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারবো । আর আপনার মনে হয় কোন সমস্যা হবে না ।''
প্রমোদের পরের কথাগুলো বুকে আগুন জ্বলিয়ে দিলো সালাউদ্দিনের ।
সে বেশ মেজাজের সঙ্গে বলে উঠলো প্রমোদকে,''মানে চুরি ? আর সে আমাকে জানিয়েই ? এ কেমন কথা ? তোমার কথাগুলো খুব বুকে লাগলো আমার । তওবা,তওবা । এমন কথা আর মনে এনো না । প্রেম বাঁচানোর জন্য এ দেখছি বড় নীচ পথ ।''
তখন প্রমোদ অস্ফুট-গলায় বলল তাকে,''না হয় দোষ চাপাবেন আমার ওপর । সবাই আমাকে খারাপ মানুষ হিসাবেই জানুক । তবু আমার আর জাবেদার প্রেম বেঁচে যাবে । তাই না ?''
সালাউদ্দিন এরপর প্রমোদের সঙ্গে কথা বলতে রাজী ছিল না । সারা মুখ কালমেঘের মতো করে নমাজ পড়তে চলল সে । প্রমোদ অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক তথাকথিত ধার্মিকের যাওয়া দেখতে থাকলো । ক্ষণে-ক্ষণে ওর চোখেমুখে পশ্চিমী মেঘ জমতে শুরু করলো ।

সেখান থেকেই প্রমোদ বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলো । এমন সময় জাবেদার মা একটা প্লেটে নাড়ু এনে ওর সামনে দাঁড়ালো । মুখে তার তখন শ্রাবণ-সন্ধ্যায় বৃষ্টি-ধরা এক চিলতে স্বস্তির হাসি । 
প্রমোদকে বলল,’’তোমার প্রিয় জিনিস নাড়ু । খাবে না তুমি ?’’ 
প্রমোদ নিজের ব্যথা সামলে নিয়ে তখন তার কাছে একটুকরো হেসে এগিয়ে গেলো ।
বলল তাকে,‘’দিন । কেন খাবো না,শুনি ? জাবেদাকে তো বলেই রেখেছিলাম আমি ।‘’ 
দুটো নাড়ু একসাথে মুখে দিয়ে প্রমোদ তৃপ্তির হাসি হাসল ।
তারপর এক ঢোঁক জল খেয়ে জাবেদার মাকে বলল,’’তাহলে আসি ? আপনারা সবাই ভালো থাকবেন । আমি অজানার উদ্দেশ্যে বেরচ্ছি খুব শিগগির । আমাকে দোয়া করবেন খুব ।‘’ 
কথাগুলো বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো প্রমোদ । কিন্তু সামনে তখন উপস্থিত হল জাবেদা । অঝোরে কাঁদছে ও । জাবেদার মা তা দেখে মুখে কাপড় দিয়ে কান্না সামলাতে সামলাতে অন্যদিকে চলে গেলো । 
সহসা প্রমোদ জাবেদার হাত ধরে চোখেমুখে অতীব ব্যথা নিয়ে বলে উঠলো,’’যা হারিয়ে যায়,তা আগলে বসে রইবো কত আর ? ভেঙে পড় না । আমাদের স্মৃতি কম নেই । স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আমরা দুজন বেঁচে থাকবো । কান্না থামিয়ে একবার হাসো । তোমার হাসিটা পাথেয় করে বেরিয়ে যাই এবার ।‘’
জাবেদা প্রমোদের হাত থেকে নিজের হাত ঝটপট সরিয়ে নিয়ে আধ-ফোটা গলায় বলে উঠলো,’’কে তোমাকে থাকতে বলেছে ? যাও,যাও ।‘’
জাবেদার মুখে হাসি না দেখেই প্রমোদ বেরিয়ে গেলো তারপরেই । তবে ও এক ঝলক হাসতে ভুলল না । বুঝি জাবেদার পাথেয়র কথা ও তখন ভেবেছিলো ।

তার এক সপ্তাহ না কাটতে কাটতে জাবেদার সতীর্থ জুনিয়র ডাক্তার মাসুদ রানা জাবেদাকে ফোনে জানায় ওর বাড়িতে,’’তোমার বন্ধু প্রমোদ তো এ দেশ ছেড়ে চলে গেছে । সাথে ওর বাবা-মাও গেছে শুনলাম । রাসেদুল ভাই আমাকে জানালো কাল । ও তো প্রমোদের বন্ধু ।‘’ 
শুনে চমকে উঠলো জাবেদা । তারপর হাপুস-নয়নে কাঁদতে শুরু করলো । কথা বলতে পারলো না মাসুদের সঙ্গে । নিজেই ফোন কেটে দিলো । মাসুদ আবার চেষ্টা করল । কিন্তু রিং হয়ে হয়ে ফোন কেটে গেলো । পরে জাবেদার মুখে জানলো ওর মা । মা কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো বাইরের ঘোলাটে আকাশের দিকে । ফুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে নিজের কাজে চলে গেলো ।
তার মুখেই পরে শুনল জাবেদার বাবা ।
সে থম মেরে থেকে থেকে শেষে বলল নিচু-গলায়,’’কি যে হচ্ছে কে জানে । মাথায় আসে না আমার ।‘’

তারপর কুড়ি-কুড়ি বছর পার । 
জাবেদা এখন দেশ-বিখ্যাত শল্য-চিকিৎসক করিম শেখের স্ত্রী । তাকে নিয়ে জাবেদা অসুখী নয় । কিন্তু একান্ত সময়ে ওর মনে পড়ে যায় প্রমোদের বড় শান্ত মুখটা । একেবারে নির্ভেজাল প্রেমিক পুরুষ ও । চোখ বুজলে জাবেদা ওর মুখ-ভরা হাসিটাও চাক্ষুষ করে । তখন ওর গাল বেয়ে ঝরতে থাকে অবিরাম অশ্রু । 
অনেক পরে জাবেদা শুনেছে,প্রমোদ এখন কোলকাতায় আছে । কি এক কোম্পানিতে কাজ করে ও । বিয়েও নাকি করেছে । একটা বুঝি ছেলে ওর । প্রমোদের মা-বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছে দেশ ছাড়ার কয়েকবছরের মধ্যে ।
জাবেদা শুধু ভাবে । ভেবেই যায়,আমার খুব মনে আছে প্রমোদকে । ওর মনে আছে তো আমাকে ? ভুলে গেলো না তো আমাকে অভিমানে একেবারে ? তখন জাবেদার সম্বল শুধু কান্না । 
স্বামী করিম শেখ তখন জাবেদার পিঠে হাত রেখে অম্লান-হেসে বোঝায়,’’নিশ্চয় মনে আছে তার । এ প্রাণের ডাক । সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে ও ? স্মৃতিপথ ধরে তোমরা এখনো দুজন হাঁটছ । সে কি কম ব্যাপার ? পরম করুণাময় আল্লাহ্ জেনে নিশ্চয় খুব খুশী ।‘’ 
স্বামীর কথা শুনে তখন জাবেদা কিশোরীর মতো মৃদু-মৃদু হাসতে হাসতে চোখের জল মুছতে থাকে ।