গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

তন্ময় বসু

ক্ষেত্রপাল



পুরো একটা বছর পর আদিত্য বাড়ি এসেছে, গাঁয়ে আষাঢ় নবমীতে পুজো হয়, ক্ষেত্রপাল পুজো। গোটা গাঁয়ের পুজো নয়, আধখানা মাত্র। তাতেই আকাশ কেঁপে যায়। বাকি আধখানা গাঁয়ের মানুষ কালীপুজোতে টেক্কা দেয়। তখন সে আর এক রূপ। বছরের পর বছর ধরে এই চলে আসছে। দু-বছর হলো আদিত্য মিলিটারীতে চাকরি পাবার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এলো। খুব অভাবের সংসারে ওর হঠাৎ পাওয়া চাকরিটার যে কি, কত দামী, তা এতগুলো বছরের জীবন দিয়ে বুঝেছে। তবে গাঁয়ে কেউ আদিত্য বলে বড় একটা ডাকে না। অত বড় গাঁয়ে ওর একটাই নাম "হুমো"। যেমন সবাই ওর বাবাকে বল'কাঁড়া-ধেনো'তার অবশ্য কারন আছে - আরেক একজন 'ধেনো' আছে, তার মুদীখানা দোকান, তাই সে হলো ধেনোমুদী। আর ওর বাবার কম বয়সের খাবার নানান গল্প আদিত্যও লোকের মুখে শুনেছে। বাপ কা বেটা, বাপের যেমন বিরাট চেহারা তেমনি অভর পেট! আদিত্যর কাঠামো বাপের মতো হলেও খাওয়ার ব্যাপারে বাপের ধারে কাছে যায় না, বরং কিছুটা হলেও রসিক। 

এবার পুজোয় বাবার বেশ জাঁক করার ইচ্ছে, দু দিদি জামাইবাবু, ফুল ফ্যামিলি নিয়ে হাজির। নেমতন্নও করা হবে জনা কয়েক। 'হুমো'ও টাকা পয়সা নিয়ে রেডী। কেজি দশেক মাংসর কমে বাবার কিছুতেই হচ্ছে না, মানে হিসেব মিলছে না। শেষে তাতেই রাজি হলো সবাই। প্রতিবার পুজোর দিনে সাত সকালে বাইরে থেকে কসাইরা অনেক ছাগল নিয়ে আসে, তার মধ্যে যেমন খাসি থাকে তেমনি পাঁঠাও থাকে দু-চারটে। দামটাও বেশ কমে হয়, সামনে কেটে দেয়। সবাই যে যার পছন্দমত ছাগল বেছে নেয়, তারপর কসাই কেটে দেয়। এবারে শুনলো ৩৮০ টাকা রেট ঠিক হয়েছে, এমনিতে বাজারে সাড়ে চারশো কমে পাওয়া যায় না। তাও নাকি গাঁয়ের লোকে সাড়ে তিনশোর উপরে উঠতেই চাইছিল না। বেলা বাড়তে বাড়তে এগারোটা বেজে গেছে, এখনও কসাইয়ের দেখা নেই। এদিকে ভীড়ের মাঝে নানারকম গল্প জমে উঠেছে। অল্পবিস্তর তর্কাতর্কিও চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যথারীতি রাজনীতির পাকা আমে সবাই মিলে কামড় বসাতেই গরম হাওয়ার সাথে প্যাচপ্যাচে ঘামের কমপিটিশন শুরু হয়ে গেল। হুমো গাঁয়ে না থাকলেও ফোনে হাল হকিকৎ সব খবর পায়। দিন কয়েক আগেই গোষ্ঠীবাজীতে এক বড় নেতা বেধড়ক ধোলাই খেয়ে শয্যাশায়ী। তিনটে ছিল, সামনেই পঞ্চায়েত ভোট বলে একটা বেড়ে এখন চার চারটে গ্রুপ। সবাই প্রার্থী হবার লড়াইয়ে। জেনারেল কাস্টের একটাই সিট, যার ভাগে পড়বে সেই এবার পঞ্চায়েত প্রধান হবে। তাই এখন থেকেই শুরু হয়েছে পেশী দেখানো। সকাল বিকেল সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। হুমোর বাবাও মাঝে বেশ কেউকেটা গোছের হয়েছিল, রোজকার এইসব গল্প শুনে শুনে, বাবাকে বাড়ি না ঢোকার হুমকি দিয়ে পার্টি ছাড়িয়েছে। এখন বাড়িতেই থাকে। ভোটের কথা উঠতেই হুমো বেশ চেঁচিয়ে বলে " শোন, আমি একটা কথা পরিস্কার বলছি, ভোট দেবার আগে হিসেব বুঝে নেব"একজন "মানে" বলতেই হুমো শুরু করে "দ্যাখো, লাস্ট পাঁচ বছরে গাঁয়ে মোটামুটি কম করে আট থেকে দশ কোটি টাকা ঢুকেছে। সাড়ে তিনহাজার ভোটার। এবারে ওর থেকে আরও বেশী টাকা আসবেই। আমাদের ওই আট দশ কোটিকে সাড়ে তিন হাজার দিয়ে ভাগ করে ভাগে যা পড়বে, আগাম দিতে হবে। নইলে নেই। বাকি তোমরা কত মারছো আমরা আর হিসেব নেব না। কিন্তু আগাম দিতে হবে"রণা কামার বলে "ওরে এটা আবার কোন পার্টি রে? নাকি আলাদা একটা গ্রুপ হলো?" হুমো বলে "আমরা হলাম জাগো ভোটার পার্টি, টাকা দাও ভোট নাও, সব নগদে কারবার। গণতন্ত্র দলতন্ত্র যাতেই বলো, এহলো নতুন অবতার।" বিকাশ তা গম্ভীর হয়ে বলে " তোদের ভোট কে চেয়েছে কে? ছাড় ছাড়, অনেক হয়েছে, আর নয়।কারো ভোট লাগবে না। সব এমনি এমনি হয়ে যাবে। অনেক আলগা দিয়েছিলাম। বলে বেড়ে গেয়েছিল। এবার কষে টাইট দেব। আর কথাটা কম বল। শুধু নাম পাঠিয়ে দিলেই পুলিশ পনেরটা কুড়িটা কেস দিয়ে দেবে। সোজা দুটো বছর কাবার, তারপর বেরিয়ে কোর্ট আর বাড়ি করতে করতেই পগাড় পাড়। তার চেয়ে বরং যেমন আছিস থাক, করে খাচ্ছিস থা, কোথাও কোন অসুবিধা নেই। বাকি সব আমরা দেখে নেবো। গ্রুপবাজী আবার কি? সাধারণ মানুষের কি অসুবিধা হয়েছে? ওতো নিজেদের মধ্যে, ওনিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।" ছেলেবেলা থেকে চেনা বিকাশ কাকুকে 'হুমো'র কেমন অচেনা লাগে। কাকুর মুখে এসব শুনে প্রথমে অবাক হলেও হুমোর মনে পড়ল যে নতুন নতুন সেকেটারী পদ পাওয়ার কথা! সবাই তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে অন্য কথায় যেতে যেতেই ছোটহাতি ভর্তি করে ছাগল নিয়ে কসাইমশাই হাজির।