গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
তাপসকিরণ রায়
জবলপুর হান্টেড কাহিনী--১১
পিপ্পল বৃক্ষ
জবলপুরের
বিটি তিন রাস্তার মোড়ে আজও সেই পিপ্পল গাছ যুগান্তরের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। এই গাছকে জুড়ে অনেক ভৌতিক কাহিনী আজও স্থানীয় লোকের মুখে মুখে ফেরে। এসব
কাহিনীর মধ্যে এক প্রেম কাহিনীর কথা আমার স্মরণে আসছে।
এও এক
যুগান্তর পার করা কাহিনীই বলতে হয়। কবিনের সময়েও সে পিপ্পল বৃক্ষ ছিল। তেমনি ঝাঁপড়ানো ছিল সে গাছ যেন
এক দিকে মাটি আর অন্যদিকে আকাশ ছুঁয়ে নেবার চেষ্টায় সাদা ব্যস্ত। গাছের অসংখ্য
ঝুড়ি ডালপালা নিয়ে সে আপন মনে দাঁড়িয়ে থাকতো। আশপাশের লোকরা অনেকেই আবার মানত করেও
যেত। মনের অভীষ্ট ফেললে তারা এসে দিনের বেলায় ধুপ
ধুনা জ্বালিয়েও যেত। কেউ কেউ পিপুল
পাতার ওপর সাজিয়ে ভোগ প্রসাদের পূজা দিয়ে যেত।
এক সঙ্গে ভয় ও ভক্তির নিবাস ছিল এই পিপ্পল
বৃক্ষের তলা।
কবিন
যুবক। সেও জানত সব। তবু সে ওই পিপ্পল বৃক্ষের নিচে দিয়েই যাতায়াত করত। তবে হ্যাঁ, রাত দশটার পরে হলে সেও আধ
কিলোমিটার ঘুরেই নিজের বাড়ি পৌঁছাত।
সেদিন
একটু তাড়া ছিল কবিনের। পিপ্পল গাছের কাছে এসে সাইকেল দাঁড় করিয়ে ভাবছিল কোন রাস্তা
ধরে ঘরে যাবে। হাতঘড়ি দেখে নিলো, রাত সাড়ে
দশটা বাজে। চারদিকে অন্ধকার যেন একটু বেশী। হতে পারে কোন অন্ধকারের তিথি হয়ত সামনে
আছে। যাক গিয়ে, একটু তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ফিরতে
হবে। কলেজের প্র্যাকটিকালের খাতা জমা দিতে হবে কাল। ভেবে সাইকেলে চড়তে যাবে ঠিক এমনি সময় দেখল, পিপ্পল গাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে
তার রাস্তার ওপরেই কেউ যেন
দাঁড়িয়ে আছে। ভয় হল তার, সে তবু
দাঁড়ালো। এদিকেই আসছে ছায়াটা--সাইকেল
ছেড়ে ছুটে কোথাও কবিনের আর পালানো হল না। অগত্যা চোখ ফেরাতেই সে দেখতে পেলো, আরে, নাজ না ! কিন্তু সে এখন কোথায় ? আরও কিছু যেন ভাবার ছিল কবিনের
কিন্তু ভাবনা কিছুতেই সে যেন আগে নিয়ে যেতে পারছিল না। নাজ তার কাছে এসে গেলো।
হাসল, কথা বলে উঠলো, কি রে কোথায় যাচ্ছিস ?
চারদিক
অন্ধকারের মধ্যেই কবিন নাজকে কিন্তু দেখতে পার ছিল। ও আর নাজ
এক কলেজেই পড়ত। না পড়ত না, পড়ে।
একটু আগে
যতই অন্ধকার ছিল না কেন, এখন
চারদিকে তাকালে মনে হবে, না, আজ পূর্ণিমা হবে। কিন্তু এত আলো
কেন ? এদিকে তো স্ট্রিট লাইট নেই ! কিংবা কবিন কি কোন অলৌকিক ঘটনার
সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ! না, এমন চারদিকের পরিস্থিতি হলেও সে
কিন্তু নাজ আর সুন্দর একটা রাত ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিল না। শুরুতে ও একবার
চমকে উঠে পেছনের দিকে তাকিয়ে ছিল বটে। কিন্তু সে যখন তার সামনে থেকে ডাক শুনতে
পেলো তখন--
--হি হি হি, সামান্য হাসির সুর কানে এলো। চমকে সে দিকে তাকাল কবিন।
--এই কবিন, আমি রে
আমি, নাজ--
--তুই এখানে এখন ? কবিন কিছু
যেন একটা ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো।
--তোকে দেখলাম, তুই এ
রাস্তা ধরবি কিনা ভাবছিস, তাই--
নাজ কবিনদের
বাড়ির ক’টা ঘর পরেই থাকে। মাঝখানে কেন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল
ব্যাপারটা এ মুহূর্তে কবিনের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না। ওর সঙ্গে ছোট বেলা থেকেই
তার চেনা জানা। নাজ দেখতে খুব সুন্দরী। ঘর থেকে বাবা মা কবিনকে সাবধান করে দিয়েছিল, এই নাজের সঙ্গে কিন্তু বেশী
মেলামেশা করিস না। ওরা জাতিতে মুসলমান। তাই মনে মনে
যাই থাক, সে আর বেশী একটা এগোয়নি নাজের
দিকে, তবে নাজের দিক থেকে একটু টান
যেন সে বরাবরই অনুভব করতে পারত। বেশ অনেক দিন আগে হবে নাজকে লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে দু
এক দিন সে কলেজে যাতায়াত করেছে, অবশ্য
সেটা বিশেষ প্রয়োজনে।
চারদিক
বেশ প্রসাধনী গন্ধে ম ম করছিলো। কবিন জানে নাজ বরাবরই সাজগোজ করতে ভালবাসে। ওর
পাশে যত বারই সে ঘেঁষেছে তত বারই
মন ভরপুর গন্ধ বরাবরই তার আশপাশে পেয়েছে। আজ নাজের প্রসাধনী গন্ধ তাকে কেমন যেন মাতোয়ারা
করে তুলচ্ছিল।
--নে সাইকেল
চালা--সাইকেলের পেছনের সিটের দিকে গিয়ে নাজ কবিনের দিকে তাকিয়ে বলল।
--তুই এখানে কি করে এলি ? কখনও সম্বিৎ ফেরার মুহূর্তে কবিন যেন বাস্তবে ফিরে আসছিল, আবার মোহময় পরিবেশে সে ফিরে
যাচ্ছিলো।
নাজ
কিছুটা হেঁয়ালির মত বলল, ওই তো ভাবলাম
আজ আমি তোর সাথে একটু সময় কাটাবো, কথার
মাঝখানে মাঝখানে নাজ একটু বেশী হাসছিল, হি হি হি, করে।
না, কিছুতেই
চলছে না, সাইকেল কেন যেন ভীষণ জাম হয়ে
গিয়ে ছিল।
--আজ রাতে তোর সাইকেল চলবে না, আমি জানি।
--কেন ?
--এমনি চাঁদনী রাতে তোকে কেন যেন খুব ভাল লাগছে রে !
--কি বলছিস তুই ?
--ঠিকই বলছি, নাজ বলল, সাইকেল রাখ ! আয় আমরা ওই পাথরের ওপরে একটু বসে
নিই।
কবিন কি
ভাবছিল কে জানে, সে কিছু না বলে চারদিকে
স্বাভাবিক চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। সত্যি জ্যোৎস্না রাত, নাজের গায়ের সুরভী গন্ধ, তাকে আরও মোহিত এক সুন্দরী নায়িকার মত লাগছে। নাজ কিছু না
বলে ধীরে ধীরে পা পা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার মাঝে মাঝে সে তার আধ মুখ
ফিরিয়ে ফিরিয়ে কবিনের দিকে হাসি মুখে তাকাচ্ছিল। পিপ্পল গাছের একেবারে পাশটাতে আধ মিটার উঁচু একটা পাথর, দেখলে মনে হবে ওদের দু জনের বসার জন্যেই
বুঝি বানানো ! অরা দু’জন সেই পাথরের ওপরে গিয়ে পাশাপাশি লাগালাগি হয়ে বসল।
কবিনের
মধ্যে আলাদা কিছু ভাবনা ছিল না--ঘটমান বর্তমানই যেন তার সবকিছু ! সে চারদিকে
একবার তাকাল। তার মাঝে নাজ বলে ওঠে, একটা কথা ভাবছিলাম---কি কথা ?
খানিক স্তব্ধতার
পর নাজ ধীরে বলে উঠলো, আমি তোকে ভাল বেসে ফেলেছি রে--
কবিন এবার
নাজের দিকে তাকাতে চেষ্টা করলো। নাজের আয়ত দুটি চোখ, ঢুলুঢুলু মায়ায় যেন ঝুঁকে পড় ছিল। ওর পরনে
সবুজ ফিনফিনে একটা শাড়ি। কপালে টিপ, চাঁদনীতে জ্বলজ্বল করছে। ওর মুখমণ্ডল
এত উজ্জ্বল চকচকে আগে তো কবিন কোন দিন লক্ষ্যই
করেনি !
--কি দেখছিস
? আমায় পছন্দ না ? বলে আবার
খিলখিল হেসে উঠলো নাজ।
--দেখছি আজ
তোকে খুব ভাল লাগছে রে ?
--তবে তোর হাতটা দে না !
--কি হবে ?
হাসল নাজ, ছুঁয়ে দেখি আমার প্রেমিকের হাত !
কবিন তার
হাত দিয়ে নাজের হাতটা ধরল, বাঃ, বেশ
হালকা, মোলায়েম, নাজের হাত, মেয়েদের
হাত বুঝি এমনি হয় ? কবিনের মধ্যে শুধু প্রেমিকের ভাব
জেগে উঠছিল। ওরা উভয়ে উভয়ের চোখের দিকে
তাকিয়ে থাকলো। এদিকে কে জানে বাইরের জগতের কতটা সময় কেটে গেছে !
এমনি কত
সময় কেটে গেছে কবিন তার কিছুই জানে না. ওর ঘুম-তন্দ্রা
যখন কাটল ও দেখল ও পিপুল গাছের তলায় শুকনো পাতার ওপরে শুয়ে আছে। তার আবেগ আবেশ তখনও
যেন পুরপুরি কেটে ওঠেনি। গাছের তলা ঝাঁপানো শাখা-প্রশাখার অন্ধকারে ছেয়ে রয়েছে। তবে চারপাশ থেকে ভোরের আলো তার চোখে এসে ধরা পড়ছিল। নাজের কথা মনে হল তার। আর মনে পড়তেই একটা প্রচ্ছন্ন হালকা
সুগন্ধ তার নাকে এসে ঠেকল। কিন্তু, কিন্তু
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো নাজ তো বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছে ! মনে হতেই
দিনের চৈতন্যে সে ভরপুর হয়ে যেন জেগে উঠলো। ধড়ফড় করে
সে উঠে দাঁড়াল, দ্রুত সে এগিয়ে গেলো নিজের সাইকেলের
কাছে আর বিনা বাক্যব্যয়ে সে সাইকেলে চড়ে ঘরের দিকে রওনা দিলো।
ঘটনা
সেখানেই শেষ হয়ে যায় নি। সে দিনের ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন কবিন নিজের
অজান্তেই কি না সে তা জানে না নাজের প্রেম পিপাসাতেই হবে, রাতের
অন্ধকারে গিয়ে হাজির হয় সেই পিপ্পল গাছের তলায়। আজকাল প্রতিদিন সে নাকি নেশায় থাকে ! নবীনের মা-বাবা, আশপাশের পারা-প্রতিবেশী সবাই জেনে গেছে কবিনের এ ঘটনার কথা। কিন্তু অনেক
চেষ্টা চরিত্র করেও তাকে প্রকৃত নেশা থেকে ছাড়াতে পারলেও অশরীরী নাজের প্রেমের নেশা
থেকে কেউ তাকে ছাড়াতে পারেনি।
এ ঘটনা
বহুদিন আগের, আজ সময়ের ব্যবধানে জীবনের কত
পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে কবিনকে কেউ আর চেনে না। তার বাবা মা ভাই বোন কে আছে, কে নেই, কেউ তার খোঁজ রাখে না।
শোনা যায়
আজও নাকি এক বৃদ্ধ পাগল রোজ রাতে শুয়ে থাকে সেই পিপুল বৃক্ষের তলায়। দূর থেকে পথ
চলতি লোকদের কানে ভেসে আসে সে বৃদ্ধের ফিসফাস কথার আওয়াজ। সে বৃদ্ধ যেন কারও সঙ্গে
কথা বলে চলেছে ! তবে আজ আর কেউ বলতে পারে না যে সেই পাগলই অতীতের সেই কবিন কি না !
শীলা ঘটক
‘সুপ্রিয় দরজাটা
বন্ধ করে দাও তো, খুব হাওয়া দিচ্ছে......বেলা হয়ে যাচ্ছে, কাজের মেয়েটাও তো এখনও এলো না’।
নন্দিনী কথাগুলো
বলে দোতলার ঘরের দিকে চলে গেল। সুপ্রিয় আর নন্দিনী এই বাড়িটায় এখন দুজন বাসিন্দা।
ছেলে রণ দশবছর হয়ে গেল আমেরিকায় থাকে। রণ একজন ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী দিশা আর ছেলে জয়
কে নিয়ে ওখানেই থাকে। তিন/চার
বছর অন্তর কোলকাতায় আসে, মা
বাবার সঙ্গে দেখা করতে। প্রায় রাতেই কম্পিউটারে ভিডিও কনফারেন্স এ কথাবার্তা হয়।
যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক গুলো কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে ! কম্পিউটারের আলো নিভে গেলে নন্দিনী কম্পিউটারের
স্ক্রীনের ওপর হাত বোলাতে থাকে। সুপ্রিয় বুঝতে পারে নন্দিনীর মনের অবস্থা ............
‘চলো
খাবে না? অনেক তো রাত হলও
মেয়েটা কখন রান্না করে গেছে, খাবে
চলো নন্দিনী’। নন্দিনী এখন ষাটের কোটায় আর সুপ্রিয় এখন সত্তর।
সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক বিশাল বাড়িতে জনমানব শূন্য পরিবেশে এই দম্পতির
কালযাপন।
ছোটবেলায় রণ যখন
স্কুলে পড়তো নন্দিনী তখন এক সরকারি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা আর সুপ্রিয় তখন তার
ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। দুজনেই তখন খুব ব্যস্ত যার যার কাজ নিয়ে...... রণ তখন নিঃসঙ্গ বলা যেতে পারে।
স্কুল শেষে একাকী সময় কাটে তার। একদিন দার্জিলিং এর নর্থ পয়েন্ট স্কুলে রণ কে ভর্তি
করে হোস্টেল এ রেখে এলো ওরা। টাকার অভাব নেই,
ভালো জায়গায় থাকলে ভালোভাবে মানুষ হবে,
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে অসুবিধা হবে না। দেশে যদি নাও হয় বিদেশে তো হবেই। কিন্তু মা-বাবাকে
ছেড়ে হস্টেলে যেতে রণের খুব কষ্ট হয়েছিল! কচি
বুকের পাঁজরে অনুভব করেছিল মোচড় দেওয়ার ব্যথা!,
কিন্তু সেই ব্যথা বাবা-মা
কেউ উপলব্ধি করতে পারল না। জামাকাপড়, বইখাতা, সাজ-সরঞ্জাম
সব কিছু দিয়ে রেখে এলো নর্থ পয়েন্ট স্কুলের হোস্টেলে।
বয়সের ভারে নুব্জ
হয়ে আসছে কোমর। হাঁটতে চলতে বেশ কষ্ট হয় নন্দিনীর। সুপ্রিয় বেশীর ভাগ সময় নিজের
ঘরে ব্যবসার কাগজপত্র দেখাদেখিতে ব্যস্ত থাকে। সময়টা যেন কাটতেই চায়না। ইজিচেয়ারে
হেলান দিয়ে ঝুল বারান্দায় বসে থাকে নন্দিনী,
ভাবতে থাকে...... ওরা
তিনজন যদি এখানে থাকতো, কি
ভালোই না হতো! বাড়িটা ভ’রে উঠত আনন্দে......
‘ওকে আমেরিকাতে না যেতে দিলেই মনে হয় ভালো হতো। ছোট থেকে ছেলেটা
আমাদের ছেড়ে হোস্টেলে থেকে বড়ো হল, যখন
বড়ো হল পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে পাড়ি দিল, তারপর
ওখানকার এক প্রবাসীর মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতে বসলো! প্রায় ছয় বছর হয়ে গেল এখানে এসেছিল’ কথাগুলো নন্দিনী বলতে থাকে।
রাত বাড়তে থাকে_____ স্মৃতির খাতার পাতা উল্টোতেই
থাকে নন্দিনী। রাস্তাটা একেবারে নির্জন হয়ে গেছে,
একটা/দুটো গাড়ি আসছে
যাচ্ছে, আনমনা চোখ দুটো
বিষাদ থেকে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করে___ কিন্তু
খুঁজতে চাইলেই কি পাওয়া যায়! কখন যে সুপ্রিয় পেছনে এসে
দাঁড়িয়েছে নন্দিনী বুঝতেই পারেনি, কাঁধে
হাতটা দিতেই ফিরে তাকায়, ‘ওহ
তুমি/ কখন এলে?’
‘এইতো
এখনি ...... ঠাণ্ডা পড়ছে___ কতক্ষণ আর বাইরে বসে থাকবে,
চলো ঘরে চলো’। নন্দিনী
ইজিচেয়ার ছেড়ে ঘরে চলে যায়। সুপ্রিয় বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে
দেয়। ‘রাত
অনেক হয়েছে, চলো খেয়ে নিয়ে শুয়ে
পড়া যাক’।
‘জানো
আমার আর ভালো লাগে না, সারাদিন সময়টা
কাটতেই চায় না। জয়টা যদি এখানে থাকতো দৌড় দৌড়ই,
লাফালাফি____ কি
ভালোই না হতো!’
‘ওসব ভেবে লাভ নেই, ও তো ওর মা-বাবার
কাছে থাকবে , নাকি আমাদের কাছে
থাকবে?’
এবার পুজোয় রণ তার পরিবার নিয়ে কোলকাতায় আসবে, মাকে ফোনে জানালো।
‘ওগো
শুনছো রণ, দিশা, জয় সবাই এবার পুজোয় কোলকাতা আসছে___ উফ আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলবো’......... নন্দিনী ফোনটা রেখেই হাঁপাতে
হাঁপাতে এসে সুপ্রিয় কে জানায়। সুপ্রিয়র ঠোঁটের কোনে হাসি,
‘ যাক অনেকদিন পর আবার আমরা একসঙ্গে হবো,
পুজোর দিনগুলো কিভাবে যে কেটে যায় বোঝাই যায় না বলো’।
‘হ্যাঁ
ঠিক বলেছ, একেবারেই ভালোলাগে
না। শোনো একদিন শপিং এ যেতে হবে। তোমার কবে সময় হবে বলতো?
ড্রাইভার কে বলে দিও অনেকক্ষণ সময় লাগবে কিন্তু’। সকালবেলার ফোনটা সারাদিনের রোদের ঝলমল
ভাবটা যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
‘আগামী
পরশু যাব শপিং করতে শুনতে পাচ্ছ?’ _____ আনন্দে
উত্তেজনায় নন্দিনীর গলার স্বরটা যেন একটু বেশী জোর শোনাচ্ছে ।
দুকাপ গ্রীন টি
নিয়ে দুজনে বারান্দায় এসে বসল, ‘ কি
গো দাদুভাই আসবে শুনে খুব ভালো লাগছে তাই না?
সেই ছয় বছর আগে এসেছিলো এখন কতোটাই না বড়ো হয়ে গেছে!’ সুপ্রিয় নন্দিনীর দিকে তাকায়_____
‘এত উত্তেজিত হয়ো না, তোমার
বয়স বাড়ছে, প্রেসার বাড়বে, একটু সাবধানে চলাফেরা করো’।
‘তোমার মুখে শুধু
অলক্ষণে কথা, ওরা কতদিন পর আসছে
বলতো!’
‘জানিতো......’
‘আমার আর তর সইছে না
বাপু, যাই বলো’।
সারাদিন দুই বৃদ্ধ মা –
বাবা প্রহর গোনে কবে ছেলে,
ছেলের বউ, নাতিকে
দেখতে পাবে।
‘ছেলেটাকে
বিদেশে না যেতে দিলেই মনে হয় ভালো হতো_____ তাহলে
আমাদের দিনগুলো এইরকম একা একা কাটতো না বলো’। বিছানায়
শুয়ে শুয়ে নন্দিনী কথাগুলো বলতে থাকে। সুপ্রিয় বার্থরুম থেকেই উত্তর দেয়, ‘ রণ কে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যাপারে আমার কিন্তু খুব
আপত্তি ছিল ... তুমি আমার কথা
শুনলে না।স্কুলের চাকরিটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলে। তখনই বলেছিলাম ব্যবসায় যা লাভ
হচ্ছে তা মন্দ নয়, বরং ভালোই বলা যায়।
কিন্তু তোমার ঐ এক গোঁ চাকরি তুমি করবেই। সেই ছেলেবেলা থেকে ছেলেটা আমাদের ছেড়ে
বাইরে রইল। আমার এটা ভালো লাগেনি’।
‘সারাজীবন এই এক কথা
আমাকে শুনে যেতে হবে, আমি জানি’.........
‘না
না কথা শোনানোর জন্য বলছি না। ছোট থেকে মা–বাবাকে
ছেড়ে থাকতে থাকতে আমাদের প্রতি টানটা কি বস্তু সেটা রণ কোনদিন উপলব্ধি করতে পারল
না। পড়াশোনা শেষ করে কটা দিনই বা বাড়িতে রইল বলো......
ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্কলারশিপ নিয়ে সেই যে আমেরিকা
গেলো _____ ওখানেই চাকরি তে
জয়েন করলো’।
নন্দিনীর চোখ দুটো জলে ভ’রে
ওঠে। ‘ ওখানেই ফ্ল্যাট কিনে নিল, মা
বাবার কথা একবার ভাবল না! ছেলেটা খুব স্বার্থপর হয়েছে জানো’। নন্দিনী বলতে থাকে.........
মুখ, হাত মুছে সুপ্রিয় পাশে এসে বসে_____ ‘স্বার্থপর তো আমরাই করেছি, তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? যখন ওর আমাদের বেশী দরকার ছিল,
তখন আমি ব্যবসা আর তুমি স্কুলের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, ওর ছোট ছোট আবদারগুলো কোনদিন মেটানোর দরকারই মনে করিনি
আমরা!’
নন্দিনীর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে।
ড্রাইভার দুলাল গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে...... ‘মা,
আমি এসে গেছি, আপনারা
নিচে আসুন’।
‘হ্যাঁ দুলাল যাচ্ছি’......... নন্দিনী ওপর থেকে কথাগুলো বলে।
নন্দিনী আর সুপ্রিয় কে নিয়ে দুলাল সাউথ সিটির দিকে
রওনা হয়________ গাড়িতে যেতে যেতে
নন্দিনী বলে, ‘দেখো ওদের জন্য পাঁচটা করে সেট কিনবো। পুজোর
পাঁচদিনে সব জামাকাপড় আমি কিনে রেখে দেব’।
রণর স্ত্রী শাড়ি
পরে না, ওর জন্য জিনস, টপ, সালোয়ার
আর রণ ও জয়ের জন্য ড্রেস কিনল।
বাড়িতে ফিরে খুব আনন্দ হচ্ছিল নন্দিনীর। রাতে ভিডিও
কনফেরেন্সে নন্দিনী পোশাকগুলো ওদের দেখালো। জয় খুব আনন্দ পেল ড্রেসগুলো দেখে, দিশার ও খুব পছন্দ হয়েছে......
বলল, ‘ভারি সুন্দর হয়েছে
মা!’ রণ বলল,
‘ এত কিছু কেনার কি কোন দরকার ছিল মা’
......
আজকের রাতটা খুব
ভালো লাগছে!_____ ওদের পছন্দ হয়েছে
দেখে। বিভিন্ন কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। এখন শুধু দিন গোনার পালা, ওরা পুজোর পঞ্চমীতে এসে পৌঁছাবে। প্রচুর কাজ এখন, ভীষণ ব্যস্ততা,
কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখতে যাবে,
কি কি রান্না হবে ...... এইসব
নিয়ে ভাবতে থাকে নন্দিনী, ঘুমই
আসতে চায় না______
আজ মহালয়া। ভোর
চারটেতে উঠে পড়েছে দুজনে। দুজনেই মহালয়া শুনতে ভালো বাসে,
এত বছরে একবারও বাদ যায়নি মহালয়া শোনা। দিনগুলো যেন কাটতেই চায় না_____ ‘ওগো শুনছো’ ____ সুপ্রিয়কে নন্দিনী বার বার ডেকে
ওঠে, এতদিন পর নন্দিনী কে এতটা
উৎফুল্ল দেখে মনে মনে খুশী হয় সুপ্রিয়। একমাসের ছুটিতে আসছে। নাতি এখন একটু বড়ো হয়েছে।সুপ্রিয় ওকে নিয়ে রোজ মর্নিং
ওয়াক করার কথা ভাবে, প্রকাশও করে ফেলে
নন্দিনীর কাছে ।
‘না
না রোজ সকালে ওকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাবে না,
ওর কষ্ট হবে। দাদুভাই আমার কাছে থাকবে,
আমি ওকে চোখের আড়াল করতে পারবোনা’_____
একনিঃশ্বাসে নন্দিনী কথাগুলো বলে যায়।
মহালয়া শুনে একটু
বেলা হতে দুজনে সকালের জলখাবার নিয়ে টেবিলে বসে,
এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। নন্দিনী তাড়াতাড়ি উঠে যায় ফোন ধরতে ____
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো নন্দিনীর কোন শব্দ না পেয়ে সুপ্রিয়
জিজ্ঞেস করে, ‘কার ফোন? কে ফোন করলো? কি
হোল? তোমার খাবারটা পড়ে আছে____ নন্দিনী ই ই’।
‘একি তুমি কাঁদছ? কি
হয়েছে? কার ফোন ছিল? কথা বলছো না কেন?’
‘ওরা
আসতে পারবে না, রণের কাজের জন্য
অফিস ছুটি বাতিল করেছে’...... কোনরকমে
রিসিভারটা রেখে নন্দিনী বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে____
সুপ্রিয় উদাস চোখে জানলা দিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের দিকে তাকিয়ে
থাকে......... আগমনীর গানে বাজে
বিষাদের সুর।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)