গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সম্পিতা দাস

আমি জিতে গেছি


রিমোট হাতে খেলার ছলেই নিউজ চ্যানেলগুলো নাড়াচারা করছে সোহম। আজ আবার মাধ্যমিকের রেজাল্ট ঘোষণা করেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। চ্যানেলে চ্যানেলে শুধু কৃতি ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল মুখ। আর হবে নাই বা কেন? এরাই তো দেশের গর্ব। কী সব ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। সোহমের খুব ভালো লাগে এই দিনগুলো। অন্তত এই ক'দিন সব খারাপ খবরগুলোকে আড়াল করে টিভির স্ক্রিন কিংবা খবরের কাগজগুলোর হেডলাইন দখল করে দেশে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

হঠাৎ একটা নিউজে চোখ আটকেছে সোহমের। "তথাকথিত সমাজের জীবন দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও নিজেকে আজ প্রমান করেছে প্রেরণা" খবরটা বিস্তারিত জানতেই সোহম ভলিয়ুমটা দু'ধাপ বাড়িয়ে দিল। প্রেরণা এবার মাধ্যমিকে ৯৬% নম্বর পেয়ে সমস্ত রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় হয়েছে আর মেয়েদের মধ্যে প্রথম। কিন্তু প্রতিবছরই কেউ না কেউ প্রথম,দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়। তাহলে এই মেয়েটি বিশেষ কেন? মেয়েটির মা একজন "যৌনকর্মী" তাই তথাকথিত সভ্য সমাজে প্রেরণাদের জায়গা হয়না। কিন্তু আজ? যেখানে মেয়েদের পরিচয় শুধুই পণ্য সেখান থেকে আজ উঠে এসেছে প্রেরণা। দিনের আলোয় যেখান দিয়ে লোক যাওয়ার সময় নাক সিঁটকায় আর রাতের অন্ধকারে যেখানে মেয়েদের শরীর হয়ে ওঠে ফূর্তির সামগ্রী আজ সেই জায়গাতেই শত শত নিউজ রিপোর্টারের ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট ঝলসে উঠছে প্রেরণার মুখে,সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রেরণা,আলোকিত হচ্ছে গোটা সমাজ।
সোহমের খুব ভালো লাগছে। সোহম বিশ্বাস করে " এদের মত মেয়েরা উঠে এলে উঠে আসে গোটা ভারতবর্ষ"
"আচ্ছা,তোমার এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের রহস্যটা কী?" নিউজ রিপোর্টারের প্রেরণাকে করা প্রশ্নে সম্বিত ফিরল সোহমের। সেও আগ্রহী প্রেরণার জীবন সংগ্রামের গল্প শুনতে। প্রেরণা দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেয় "আমার সাফল্যের চাবিকাঠি আমার দুই মা, দেবকী আর যশোদা" প্রেরণার দুই পাশে দাঁড়িয়ে গর্বের হাসি হাসছে দুই মা। তাঁরা দুজনের নিরবতার একটাই মানে "আমরা জিতে গেছি" চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাটিকে দেখেই বোঝা যায় ইনি প্রেরণার জন্মদাত্রী মা। কিন্তু আরেক পাশে এ কাকে দেখছে সোহম?
সোহমের সাথে স্নেহার আলাপ সেই কলেজ লাইফ থেকে। সোহম কেমিস্ট্রি আর স্নেহা অঙ্ক। বন্ধুত্বটা তথাকথিত প্রেম হয়ে যেতে খুব একটা সময় নেয় নি। আজ থেকে বছর তিনেক আগে কফিহাউস বা  কলেজস্কোয়ারের আশেপাশে প্রায়ই দেখা যেত দু'জনকে। ওদের বন্ধুদের ভাষায় ওরা নাকি এযুগের রোমিও-জুলিয়েট। গ্র্যাজুয়েশনের পর দুজনের রাস্তা আলাদা। স্নেহার বাবা নেই, পেনশনের টাকায় দিন কাটানো দায়। তাই স্নেহা চাকরির পথ বাছে আর সোহম এম.এস.সি। দেখা করার দিন সংখ্যা কমে। তখন মুখপুস্তিকার অত রমরমা ছিল না। তাই যোগাযোগের মাধ্যম ফোন আর এস.এম.এস। তবু দূরত্ব বাড়তে দেয়নি কেউই। সারাজীবন একসাথে চলার শপথ  নিত রোজ!

এমনই একদিন সোহম আর স্নেহার কমন্ ফ্রেন্ড তন্ময় কিছুটা হন্তদন্ত হয়েই সোহমকে ডেকে পাঠায়। সে জানায় সমাজের চোখে তথাকথিত "নিষিদ্ধ পল্লী"- এক বাড়িতে নাকি স্নেহার নিয়মিত যাতায়াত। সোহম বিশ্বাস করেনি,আবার হয়তো কিছুটা বিশ্বাস করেওছিল। তার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভন্জন করতেই সোহম পৌঁছে গেছিল সেখানে। সোহমের গা ঘিনঘিন করছিল। বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারছিল না। সদ্য কেনা পালসারে হেলান দিয়ে একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। ঠিক রাত আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল স্নেহা। স্নেহা এগিয়ে চলেছে। সোহম বাইকে স্টার্টটুকু দেওয়ারও শক্তি পাচ্ছে না। বাইক স্টার্ট দিয়ে হঠাৎই সোহম স্নেহার পাশে। " টাকার জন্যে নিজেকে বিকিয়ে দিলে স্নেহা? ঘেন্না করি,তোমায় আমি ঘেন্না করি,তোমার বেশ্যাবৃত্তিকে ঘেন্না করি" - এটুকু বলেই বাইক হাঁকিয়ে হাওয়ার গতিতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছিল সোহম। প্রত্যুত্তরে কিচ্ছু বলার সুযোগ দেয়নি সেদিন।

টিভিতে স্নেহার গলার আওয়াজে ঘোর কাটল সোহমের।
প্রেরণার পাশে স্নেহা,প্রেরণার যশোদা মা। আজ স্নেহা বলবে আর গোটা পৃথিবী শুনবে। নিউজ রিপোর্টারদের ক্যামের,মাইক ঘুরে গেছে স্নেহার দিকে। স্নেহা বলে চলেছে "পিছিয়ে পড়া মেয়েগুলোর জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল বরাবরের।কারণ সমাজের মূল স্রোত এদের চলার পথের বিপরীতগামী। রোজ অফিস শেষে পড়াতে আসতাম। বইয়ের শিক্ষা নয়,জীবনের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। আজ এরা জীবনশিক্ষায় শিক্ষিত। প্রেরণাই প্রেরণা হয়ে থাকবে এদের সবার জন্য। এরকম একটা জায়গা যেটা তথাকথিত সমাজের চোখে "নিষিদ্ধ পল্লী" সেখানে রোজ আসা যাওয়ার জন্য আমাকেও কম লড়াই করতে হয়নি। হারিয়েছি অনেক কিছু আজ পেয়েছি তার থেকে অনেক বেশী। আর যারা আমায় ভরসা করেনি,অবিশ্বাসে ভুল বুঝেছে তাদের আজ একটা কথাই বলব যে আমি জিতে গেছি"