গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শ্রী সেনগুপ্ত

খুকু' ডায়েরী - সূর্যাস্ত------


সূর্যাস্ত বা সন্ধ্যাবেলা আমার কোনদিনই পছন্দের সময় নয় সেই ছোট্ট বেলা থেকে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সেই আলোর রোশনাই থেকে অন্ধকারের পাঁচিল তুলে দেবার জন্য বোধ হয়। সেই লাল মেঝেতে সারাদিনের রোদ লুটোপুটি খেয়ে মাতিয়ে রাখত সারাদিনটা, তারই অব্যাহতি বিকেলের পর থেকেই। আমারও সারা পাড়া বেরিয়ে এসে বা পুতুল খেলা শেষ করে সেই সময় বই নিয়ে পড়তে বসা। কেমন যেন সময় ফুরিয়ে যাবার কষ্ট চেপে বসত মনে। সারাদিনের যত খুটিনাটি খুনসুটি ঝাঁপিয়ে
পড়ত সেই সময় একে একে। সবার সঙ্গে হাত 'রে গল্প 'রে অভাব অভিযোগ শুনে তবেই তাদের থেকে রেহাই। বইয়ের পাতা একলাই উড়ত পাখার হাওয়ায় চোখের সামনে। বাড়ির সামনের চেনা গাছগুলো পর্যন্ত নিজেদের কালো পর্দায় ঢেকে নিত। একমাত্র খুব জোরে বাতাস বইলেই সে পরদা উড়ে গিয়ে তাদের নড়াচড়া বোঝা যেত। নাহ'লে কোনও প্রাগৈতিহাসিক জীবের মত হাত পা মেলে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকত
পাঁচিল ছুঁয়ে। শরৎ কালের সন্ধ্যা যেন আরো বেদনাময়
অমন সুন্দর নীল আকাশ আর সতত পরিবর্তনশীল পেঁজা তুলোর মত মেঘের অদৃশ্যমানতা আমার খুব কষ্ট দিত। কতবার কতকত চেনা অবয়ব খুঁজে পেয়েছি সেই ভাসমান মেঘের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা অস্তিত্ব থেকে। খুব ইচ্ছা করত, যুবতী সময়ে, আমার খুব প্রিয় কারোর হাত ধরে হেঁটে বেড়াই মেঘের পরিধি বেয়ে। দুর থেকে আমাদের দেখুক সবাই। স্বপ্নের মত। আমিও দেখি আমার বাড়ি। উঠানে মায়ের ঘোরাফেরা। নয়নতারার মাথা দোলান। সদরের পাশে শুয়ে থাকা ভোলুকে। আর আদরের মিনুকে গ্রিলের ফাঁক গলে শরীর বেঁকিয়ে ঢুকতে। খুব ভাল লাগত নীল আকাশের বুকে মেঘ আর মেঘের বুকে পাখিদের সারিবদ্ধ ভাবে উড়ে যাওয়া। কেউ শেখায় নি অমন শৃঙ্খলাবদ্ধ 'তে, তবুও কেমন যেন জন্ম থেকেই শিখে যেত ঠিক, নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখলে সাবলীলতা বা সৌন্দর্য দুইই বজায় থাকে। এর নাম স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা নয় মোটেই। খুব ইচ্ছে 'রত ওদের সাথে উড়তে উড়তে বনপলাশীর মাঠ, অবনীদের পুকুর, বিলের হাট , হাটখোলার ইটভাটার উঁচু চিমনির পাশ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে ওদের বাসা পর্যন্ত যেতে। কেমন ' ওদের বাসা? কে কে থাকত ওদের বাসায়? আর সূর্যটাও কেমন যেন নিভে যেত সেই সময় ঠিক। পরিস্কার আকাশে মেঘ আলোর খেলা শুরু 'য়ে যেত ঠিক তারপর। কতকত মেঘ আর রাশি রাশি আলো চিত্রিত আকাশের বুক জুড়ে। যেন এতক্ষণ বাবার কড়া শাসনে ওদের খেলা থেমেছিল।
বাবা চলে যেতেই হুড়মুড়িয়ে উঠোন জুড়ে আলোর রোশনাই। কত যে রঙ আর কত বড় যে ক্যানভাস আর কি জানি কোন শিল্পীর অদ্ভুত তুলির টানে কেমন কেমন অস্তিত্ব ফুটে উঠত আকাশ জুড়ে, অবাক হয়ে দুচোখ দেখত আমার। ধীরে ধীরে আলোটুকু সব শুষে নিত আকাশ। ঘুমিয়ে পড়ত হঠাৎ জেগে ওঠা শিল্পী। কাল যে আবার অনেক ভোরে উঠে আঁকতে হবে আকাশ ক্যানভাসে। ঠিক সে সময় তুলসী তলায় গলায় আঁচল জড়িয়ে মায়ের শঙ্খে' আওয়াজ। যেন সাক্ষাৎ দেবী। ইচ্ছে 'রত ছুট্টে গিয়ে মাকে জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে দি। কতবার ছুট্টে গেছি, মাকে জড়িয়ে ধরেছি। মা চিৎকার করেছে ওরে ছাড়, বাসি কাপড়ে ধরিস না আমায়। তারপর আমায় বুকে টেনে নিয়ে আদর 'রে মাথায় হাত বুলিয়েছে। আমি মায়ের বুকে কাঁদতে
কাঁদতে বলেছি মা আমি কখনও কোথাও তোমায় ছেড়ে যাবো না। মা বলত পাগলী কোথাকার।

---------------
হলুদ স্ট্রিট লাইটের আলো চুঁইয়ে পড়ত রাস্তায়। ধীর পায়ে রিক্সায় প্যাডেল 'রতে 'রতে সেই হলুদ আলো মাখতে মাখতে পেরিয়ে যেত পটাদা' রিক্সা। প্রতিটা প্যাডেলে জীবনের সব দুঃখ অতিক্রম করার অদম্য বাসনা। রিক্সার তলায় নিজের ছায়া'টা কেমন যেন নিজেই অতিক্রম করতে চাইত।

সেই ছায়া এগিয়ে যাবার সাথে সাথে লম্বা 'য়ে আরো একটা ছোট ছায়ায় রূপান্তর করে নিতো এক আলোকস্তম্ভ থেকে আর এক আলোকস্তম্ভের মধ্যে। যেন প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন মত পরিবর্তন 'রে নিতে পারা। সিধু জেঠু আমাদের পড়শী। জেঠিমা মারা গেছে মাস ছয় হয়েছে। আমি তখন বারো ক্লাস। ঠিক কোনও কোনও সন্ধ্যা বেলা দরবারি, মালকোষ চালিয়ে শুনত। একেই এমন সব দৃশ্যের সমাহার।
তারপর দরবারির তরবারি। প্রতিটা মীড়ের টান যেন ভিতর টা ফালাফালা করে দিত। অনেকবার বলেছি জেঠু কেন তুমি ওমন অসময়ের রাগ বাজাও অসময়। জেঠুর উত্তর আমার যে তখন ওটাই শুনতে ইচ্ছে হয় খুকু। সত্যিই নিয়ম মেনে সব কিছু সবসময় কেনই বা হবে।

------আমি কথা রাখতে পারি নি। ছেড়ে এসেছি মাকে। এখন এমন সন্ধ্যা বেলা এমনি একলাই খালি 'য়ে যায়। সাথে থাকে কিছু বুক ভরা কষ্ট। কেউ আসে না আমার বুকে। 'মা' বলে কেউ করে না আমায় ছেড়ে না যাবার অঙ্গীকার। আমিই শুধু শঙ্খ বাজিয়ে গলায় আঁচল দিয়ে ঠাকুরের সামনে নতজানু নতমস্তক হয়ে সবাইকে ভালো রাখার অনুরোধ করি দুর থেকে। কেউ আমার কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ হয় নি আমায় ছেড়ে না যাবার...