গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মনোজিৎকুমার দাস

গড়াই নদীর ইলিশ 

কলকাতা থেকে কার্তিক সেন তাঁর জমিদারি সেরেস্তার নায়েবকে লিখেছেন " শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারী কাচারিতে আসিতেছি । জানিপুরের ঘাটে বোট রেডি রাখিবে । খোকসা রেলস্টশনে রহমত ঘোড়াগাড়ি নিয়া যেন প্রস্তুত থাকে । কত তারিখে গোয়ালন্দ মেলে আসিবো তা পরের চিঠিতে জানাইতেচ্ছি । " এইটুকু পড়ে নায়েব মশাইয়ের যেন মাথাটা ঘুরে যাবার অবস্থা ! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রহমত পেয়াদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জমিদার বাবুর চিঠির বাকি অংশে চোখ রাখলেন । কার্তিক সেনের হাতের লেখা যেন ছাপার অক্ষরের মতো । " ললিত , তুমি হয়তো এটা জেনে অবাক হবে এই ভেবে এ সময়ে কলকাতার বালিগঞ্জ ছাড়িয়া আমার মতো ফুলবাবু জলজঙ্গলে ঘেরা জমিদারির তদারক করিতে বাঙাল দেশে যাইতে মনস্থ করিতেছি কেন । তবে শোন , চক্রদহের মিলনবাবু ঘোড়ার রেসে আমাকে এক হাত দেখানোর পর ... তিনি আমাকে বললেন' ঘোড়ার রেসে হারজিত্‍ আছে । মন খারাপ করিবেন না । আমি বর্ষার সময় আমার জমিদারিতে ফিরে যাব । বর্ষা শুরু হলে তো রেসকোর্সে ঘোড় দৌড় বন্ধ হয়ে যাবে । আসুন না কার্তিক বাবু বাঙাল দেশের বর্ষা দেখে আসবেন । আপনার নায়েব গোমস্তরা তো বাজার থেকে পদ্মার ইলিশ খাইয়েছে , গড়াই নদীর ইলিশ তো ওরা খাওয়ানি , আর শাংলে জালে গড়াই নদীতে ইলিশ ধরার কী যে আনন্দ ! শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারি দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়ে নায়েবকে চিঠি দিন ।আমিও থাকবো । আসুন গড়াই নদীতে ইলিশ ধরা যাব ।' তাই আমি বর্ষাকালে আসিতেছি ।  ”                                                                                                                                          
জমিদার কার্তিক সেনের চিঠির সবটা পড়ে ললিত নায়েব বিড়বিড় করে বললেন , এ দেখছি বড় একটা ল্যাটা ! রহমত নায়েব বাবুর কথা ভাল ভাবে বুঝতে না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করল ,' জমিদার বাবুর কি লিহেছেন , খারাপ কিছু !' " জমিদারবাবু আসছেন এ মাসের শেষ দিকে....." বিরক্তি সহকার ললিত নায়েব রহমতের কথার জবাব দেন ।" কী কন !নায়েব বাবু , তিন মাস তো হয়নি তিনি আসি গেলেন, আবার আসতিছেন ক্যানে বান বর্ষার মধ্যি ! বানের জলে প্রিজ্জা গেরে ধানপান ধৌত হইছে ইবার , কনথিকে তারা নজরানা দিবে নে !" রহমতের কথা শুনে নায়েব মশাই পিয়াদার ওপর ঝামটা মেরে ওঠেন এই বলে, " নিজের চরকায় তেল দাও গে , রহমত । জলবর্ষায় জমিদার বাবু এলে পাড়ে তোমার কাজ বেড়ে যাবেনে ভাবে দেখিছ । বাবু এবার গড়াই নদীতে ইলিশ শিকারে আসছেন ।" নায়েব বাবুর কথা শুনে রহমত বলে উঠল ," সে তো ভাল কতা ! হানুগাঙেও তো বেজায় বান ডাকিছে । সুদোর পুরের কফিল মোড়ল নাকি ছাকনা জালে হানুগাঙ থিকে ইলিশ ধরিছে গত পরশু ।"
 " তাতে অবাক হবার কী আছে ! হানু গাঙ তো জলে কানায় কানায় ভরা , গড়াই থেকে ভাটির টানে ইলিশ এ গাঙে আসাটা বিচিত্র কী !" ললিত নায়েব ভাবেন , কার্তিক সেন পদ্মার ইলিশের পাতুরি , সর্ষে ইলিশ খেয়ে রসনা তৃপ্ত করতে এখানে আসছেন । কলকাতায় গঙ্গার ইলিশে কী পদ্মা ইলিশের মতো স্বাদ আছে ! গড়াই নদীর ইলিশে নানা ব্যঞ্জন খেলে কার্তিক সেন তো পাগলই হয়ে যাবেন । যাক , বাবু এবার বর্ষায় এলে গড়াইয়ের ইলিশ খায়িয়ে পাগল করে দেব । রহমত কালও এক টাকায় এক হালি গাড়াইয়ের ইলিশ কিনে এনেছে বাঞ্চা মাঝির কাছ থেকে । অবশেষে , কার্তিক সেন গড়াই নদীর ইলিশ শিকারের জন্যে এসে উপস্থিত হলেন । কার্তিক সেন এর আগেও গড়াই নদী পথে কলকাতা থেকে জমিদারি তদারকি এসেছেন , এবারই প্রথম বর্ষাকালে এখানে আসা । বর্ষাকালের প্রমত্তা গড়াইকে এবারই তিনি প্রথম দেখলেন । এবার যেন কার্তিক সেন গড়াই নদীকে অন্য দৃষ্টি দেখতে পেলেন । রহমত ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে খোকসা রেলস্টেশনে গোয়ালনন্দ মেইল আসার অপেক্ষায় ছিল । স্টেশনে ট্রেন ভিড়তে সে দূর থেকেই দেখতে পেল ফার্স্ট ক্লাশ কামরার জানালায় জমিদার মুখ চোখে পড়ল ।
রহমত জানিপুরের গড়াই নদীর ঘাট নৌকা রেডি করে রেখেছে । জানিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে কুঠি বাড়ি বেশি দূর নয় । পদ্মা আর গড়াইয়ে মাঝামাঝি স্থানে শিলাইদহ । রবীন্দ্রনাথ বোটে যেমন পদ্মনদী দিয়ে চলতেন তেমন ভাবে গড়াই নদী দিয়েও চলাচল ।কার্তিক সেনের মনে পড়ল গীতাঞ্জলির অনেক কবিতা জানিপুর গড়াই নদীর ঘাটে বসে লিখেছিলেন । পাল তুলে দিলে ভাটির টানে ছুটতে খাকল । বাঁক ঘুরতেই কার্তিক সেনের চোখ পড়ল পাল তোলা অসংখ্য ডিঙ্গি নৌকা । রহমত বলে উঠল ,"দেখেন বাবু , নদীর বুকে কত ডিঙ্গি নৌকা । শাংলে জাল পানিতে ফেল জালের দড়ি বসে ধরে আছে , আর একজন বোইটা টানছে । ইলিশ জাল আটকালেই জাল টেনে তুলবে । " জমিদার বাবু ইলিশ ধরার দৃশ্য দেখার জন্য নৌকার ছই এর ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন । উজান ঠেলে আসা একটা নৌকার দিকে চোখ পড়তেই কার্তিক সেন দেখতে পেলেন দড়ি ধরে বসে থাকা লোকটা আস্তে আস্তে তার হাতে দড়ি টেনে তুলছে । সত্যিতো জালে আটকা পড়া বড় সাইজের একটা রূপোলি রঙের ইলিশ জাল থেকে ছাড়িয়ে নৌকার খোলের মাঝে ফেল দিয়ে লোকটা আবার তার জালটা জলে নামিয়ে দিতে দেখলেন । তিনি মনে ভাবলেন , কতবার জমিদার দেখতে এপথে নৌকায় গিয়েছি ,এমনকরে ইলিশ ধরা দৃশ্য তো দেখিনি । জমিদারবাবু বলেন ," রহমত, ওরা কি নৌকা থেকে ইলিশ বিক্রি করে ? বিক্রি করলে কয়েকটা কিনে নেওয়া ..." "বলতিছেন কী ! আমাগেরে কী কিনে খাতি হবি । রাতির বেলা আমি দুই হালি ইলিশ ধরিছি ।তার থিকে এক হালি ইলিশ নায়েব বাবুকে দিছি ।" " তাই নাকি , রহমত ।" কার্তিক সেনকে নিয়ে রহমত কাচারি বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়াল সন্ধের আগেই । চক্রদহের জমিদার মিলন বাবু ও নায়েববাবু ঘাটে অপেক্ষা করছেন দেখে কার্তিক সেনের মনটা বেজায় খুশি । রাতে রহমতের দেওয়া ইলিশ মাছের নায়েব গিন্নির রান্ন করা নানা পদের ব্যঞ্জন থেয়ে কার্তিক সেন বেজায় খুশি হয়ে নায়েব বাবুকে বললেন গড়াই নদীর ইলিশের সাদই আলাদা । কার্তিক সেন যে কয়দিন কাছারি বাডি ছিলেন সেই কয়দিনই গড়াই নদীতে ইলিশ ধরতে গেলেন রহমতদের সাথে । সাথে মিলনবাবু আর নায়েব বাবুরা ছিলেন । তরতাজা ইলিশ ধরা পড়ল ও হালিহালি । নায়েব গিন্নির হাতের রান্না করা গড়াই নদীর ইলিশের পঞ্চ ব্যান্নন আর ইলিশের তেল খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন জমিদার বাবু কার্তিক সেন । কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নায়েব বাবুকে কার্তিক সেন বলে গেলেন গড়াই নদীর ইলিশের স্বাদ নেওয়ার জন্য প্রতি বছরই বষাকালে এখানে আসবেন ।