গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শেখর কর

রিংটোন

ইনবক্সে অচেনা মেসেজ ! আজকাল অবশ্য এসবে অভ্যেস হয়ে গেছে রাইয়ের । বছর দুয়েক আগে দাম্পত্যজীবন থেকে ফাঁকি দিয়ে আচমকা সজল চলে গেল । এখন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই এতবড় বাড়িতে দিন কাটে শূন্যতায়  ।  তবু ভাগ্যিস কনভেন্টের শিক্ষকতার চাকরীটা ছিল । নইলে বাপের বাড়ি থেকে এতদূরে এই ভিন রাজ্যের  এই পাহাড় ঘেরা ছোট্ট ছবির মত শহরে একাকীত্ব যেন গ্রাস করে ফেলত অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলটা নিয়ে দোতলার নিরিবিলি ব্যালকনিতে বসে আত্মীয়স্বজনদের সহানুভুতি ও সবার অকৃত্রিম ভালবাসায় যেন পথ চলা ।

বিরক্তির সঙ্গে খুলতেই অবাক হয়ে দেখল রাজার মেসেজ ! তা প্রায় ৩০/৩৫ বছর তো হবেই । কুমারীকালে ওর সঙ্গে অনেক জলসায় গান গেয়েছে । এক মাথা চুল আর রোগাটে গড়ন সেই চেহারার বদল হয়েছে বটে তবে চিনতে একদম অসুবিধা হয়নি রাইয়ের । ওদের বাড়িতে এসে গানও গেয়ে গেছে রাজা । এখনও মনে আছে সেই গান দুটো ভালবেসে সখিআর যে ছিল আমার স্বপনচারিণী ওর সঙ্গে সম্পর্ক খুবই সহজ ছিল রাইয়ের । রাজাও কোনদিন তেমনভাবে কিছু বলেছে বলে মনে পড়েনা রাইয়ের । শুধু একটা আলগা ভাল লাগা ছিলই ।  মেসেজের উত্তরে কুশল বিনিময়ী একটা উত্তর দিয়েছিল রাই । ব্যস্ ।

পরদিন ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ফোন এলো রাজার । অনেক কথা হল দুজনায় । বাড়ি ফিরে এসেই রাজাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্টেড হয়ে গেল ।
এরপর থেকে প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপে ফোনে রাই যেন প্রাণ ফিরে পেল । রাজার কথার যাদুতে কবিতায় গানে ভরে উঠলো শূন্য প্রহর গুলো । ইচ্ছে করেই রাজাকে জানায়নি ওর একা হয়ে যাওয়ার কথা । হয়তবা নিজেকে একটা লক্ষনরেখার শাসনে বেঁধে রাখার ইচ্ছেতেই । রাজা কিন্তু সেই পুরোণোদিনের কথার মধ্য দিয়ে অকপটভাবে বলে দিয়েছে যে ও রাইয়ের প্রেমে পাগল ছিল । এও বলেছে যে- বয়স মানুষকে অনেক সহজ করে দেয় । এখন এসব কথা বলাই যায় কারণ সে সময় শুধু মধুর স্মৃতির সুবাস বয়ে আনে । রাই বুঝতো রাজার সরলতা । তাই বাধা দিত না আবার এড়িয়ে যেত না । প্রতিদিন একটা অদ্ভুত মোহে অপেক্ষা করত একটা ফোনের । সারাদিনের ফিরিস্তি শোনা আর বলা ।

আজ প্রায় ছমাস বাদে গতকাল সমস্ত বলয় ভেঙে রাজাকে জানিয়ে দিয়েছে যে ওকে সংসারে একা ফেলে রেখে সজল চলে গেছে না ফেরার দেশে । রাজার প্রতিক্রিয়া শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেল রাই ।অন্তহীন অনুশোচনায় বারবার বলতে লাগলো কেন আমি বলতে গেলাম অকপটে সব কথা । আমি জানি তোমার ভরা সংসারে আমার একথাগুলো বিঁধবে না তোমায় বরং ছোটবেলার পুতুলখেলার স্মৃতির মত আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হবে । একবারও যদি জানতাম কখনোই বলতাম না ।

আজ বহুদিন পর বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দোতলার ব্যালকনিতে বসে অনেকক্ষন শিশুর মত কাঁদলো রাই । বাপের বাড়ি , মেয়েবেলার সেসব গান নাটকের দিনগুলো,ইউনিভার্সিটির হোস্টেলজীবন । অবশেষে পরিযয়ী পাখির মত উড়ে এসে বাসা বাঁধা আর সজলের চলে যাওয়া । কান্নায় যে এত সুখ আছে জানতনা সে । বুকের ভেতরটায় যেন পুরো আকাশটা দেখতে পাচ্ছে আজ ।
কি করে বোঝাবে  রাজাকে যে ওর সরল সান্নিধ্য ছাড়া যে একটা দিনও চলেনা রইয়ের কারণ এই মানুষটি ঝড়ের মত এই মাঝবয়সে এসে জানিয়ে দিয়েছে জীবন শুধু চলে যাওয়ার জন্য নয় , জীবন জীবনের কাছে ভীষনভাবে ফিরেও আসতে চায় ।
 
ভাদ্রশেষের বিকেলের অস্তরাগে রাঙা একটা দলছুট্ মেঘ হারা উদ্দেশ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে । সামনের বড় গাছটায় ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব ছাপিয়ে বেঁজে ওঠে রিংটোন ।