গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিজয়া দেব

পশুপতি ও চাঁদ
   

সোনার থালার মত চাঁদ । আজ একাদশী । গতকাল পূর্ণিমা ছিল । পূর্ণিমার চাঁদ হয় রূপোলি । আর একাদশীর চাঁদ ?  গোল সোনার থালা যেন । চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে পশুপতি । তাকাতে তাকাতে চোখটা ভরে ওঠে । আহা , চমৎকার চাঁদটি । ছোটবেলায় বুড়ি ঠাকমা বলতো , ‘ কাঁদিস নে পশু , তোকে আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে দেবো ।পশুপতি বলতো , ও ঠাকমা , চাঁদ দিয়ে কি করতে হবে ? খেলবি । ’’ পশুপতি ভাবতো , ভারি মজা তো , চাঁদ নিয়ে খেলা ? তা সে কেমন খেলা ? ঠাকমা বলতো , ঐ লোফালুফি খেলা ! তোর চাঁদ ওর হাতে , ওর চাঁদ তোর হাতে । বাহ , বেশ খেলা তো ! কিন্তু চাঁদের গায়ে ওসব কি ? কালো কালো ছায়া ছায়া ? ঠাকমা গো , চাঁদের গায়ে ওসব কি ? কালো কালো , ছায়া ছায়া ? ঠাকমা একটু ভেবে নিয়ে হেসে হেসে বলতো , হাতে পেলে দেখে নিস বাছা । পশুপতি চাঁদ দেখতোএকটু একটু ভয় ভয় করতো । কেমন ভূতুড়ে ছায়া । অতো  সুন্দর জিনিষটায় ওসব না থাকলেই তো হতো ।

     পশুপতির বয়েস হয়েছে । কত বয়েস ঠিক গুণে বলতে পারবে না সে । জন্মের সময় খুব খরা ছিল । ঠাকমা বলতো । ঠাকমার কথা খুব মনে পড়ে । ঐ চাঁদের দিকে তাকালে আরও বেশি মনে পড়ে । পশুপতির আজ সকাল থেকে জ্বর । সারাদিনে কিছু মুড়ি গেছে পেটে । জল খেতেও ইচ্ছে হচ্ছে না । বাড়িতে কেউ নেই । পশুপতি একা । পাশের ঘরে ছেলে , ছেলের বউ আর নাতিপুতি আছে বটে , ওরা প্রায় দিন কেউ আসে না । সে নিজেই চারটি ফুটিয়ে খায় । মাঝে মাঝে ছেলের বউ একটা দুটো তরকারি দেয় , মনে হলে , ইচ্ছে হলে । চলে যাচ্ছিল একরকম , গতকাল থেকে জ্বর ।

   ছনবাঁশের ঘর । ছেলে তার প্ল্যাস্টিক কারখানায় কাজ করে । পুরনো ভিটে । পাশাপাশি দুটো ঘর , দাওয়ায় দাওয়ায় এঘর ওঘর চলাফেরা চলে । কিন্তু পশুপতি আজকাল ওদিকটায়  যায় না । ভালোবাসা নেই , টান নেই , মমতা নেই । ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে সে , বয়সবেলায় হারিয়েছে বউ । ঠাকমা তাকে বড্ড ভালবাসতো

    আজকাল সন্ধ্যার পর মাটির দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে থাকে পশুপতি । শুক্লাতিথিতে চাঁদের গড়নে বদল দেখে দেখে নেশা ধরে যায় । চাঁদের ছোটবেলা , মাঝবেলা , বুড়োবেলা , তারপর আঁধারে আঁধার । কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের গায়ে হেলাফেলার ছাপ । এই যেমন তার দূর ছাই হওয়া বুড়ো জীবন । গায়ে হাজারটা অসুখ । আজ এই সোনালি চাঁদের গায়ে কালো কালো ছায়া দেখে পশুপতি আর ভাবে ছোটবেলা থেকে ঐ চাঁদ তার সাথে জড়িয়ে গেছে দিব্যি । আজও সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও চাঁদ তাকে ছেড়ে যায়নি । কাল থেকে চাঁদের ক্ষয় হবে । ক্ষয়ে ক্ষয়ে মিলিয়ে যাবে আঁধারে । তারপর নিশ্ছিদ্র আঁধার অমাবস্যা । মাথাটা খুব ভারী হয়ে আসে , আর বসে থাকতে পারে না পশুপতি । মস্ত গোল সোনালি চাঁদ মুখোমুখি তাকিয়ে থাকে । আজ তার গায়ের কালো কালো ছায়াগুলো বড়ো বেশি স্পষ্ট , প্রকট ।