গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

অবগাহন


হ্যারিকেনের কাঁচ গুঁড়ো ছাই দিয়ে মুছছিলো ছোটমা। কনে দেখা আলোয় নাকের ডগাটা সোনালি । মাথার উপর থেকে ঘের দেওয়া সাদা থানের ঘোমটা সরে গেছে। কদম ছাঁটা চুল। চোদ্দ বছরের বাপ-মা মরা মেয়েটাকে নিজের ডানহাত গগনের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো আমার বাবা। পনেরো বছরে মা হলো ছোটমা। ছেলেটা জন্মেই মরলো। সবাই বললো,পেঁচোয় ধরেছিলো। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁচা হলুদ রঙের,ঘন কালো একঢাল কালোচুলের মাহওয়া মেয়েটা,গোয়ালঘরে পড়ে রইলো। এর একহপ্তা পর গগন মরলো আলের উপর কেউটের ছোবলে।তোমার বাপ আমার কোলে ধপ্ করে তোমারে ফেলে দেছেলো মণি,বলেছেলো,’নে মানুষ কর,’ মা আমার চিরকালের রুগী,জবুথবু,না ঘুমায়। না খায়। ঠাকুরথানে মানত করে,বদ্যি,ওষুধপালা করে বেশি বয়সে আমি মার গর্ভে এসেছিলাম। এসব কেমন করে নিজে নিজেই জেনে গেছিলাম,খানিক বয়স হয়ে। মার বুকে দুধ ছিলোনা। ছোটমার ছেলেকে পেঁচোয় ধরলো। আমি বেঁচে গেলাম অতিকষ্টে। ছোটমার বুকে। মা,’ছোটমাডাকতে শেখালো আমার কথা ফোটার সাথে সাথেই। আর কিছুতেই ছোটমার চুল কাটতে দিলোনা। চুলের ভার নিয়ে ছোটমা সাদা থানে কেমন শিউলি ফুল হয়ে থাকলো। ছোটমা আর আমি একসাথে বড়ো হতে লাগলাম। ছোটমা যুবতী । আমি কিশোর। বাবা সেরেস্তা থেকে ফিরে হুঁকো হাতে দালানে বসে ছোটমাকে দেখছে। ছোটমা উঠানে মুড়ি ভাজছে ...ছোটমা সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে তুলসীতলায় ...ছোটমা মার গা ধোওয়া জামাকাপড় মেলে দিচ্ছে,, আমি টের পেতাম। মুনিশ খাটতো জমিতে আমাদের আটজন। জমির ধারে মাচায় ঘর বেঁধে পালা করে দুজন জমি পাহারা দিতো। তাদের পেটাই চেহারা রোদের আলোয় তামাটে চকচক করতো। দুপুরে তাদের ভাত বেড়ে দিতো বামুনমাসী ছোটমা এগিয়ে দিতো ভাত,ডাল,তরকারী,যেদিন পুকুরে জাল ফেলা হতো,সেদিন মাছ,আমি পাঠশালায় যেতে যেতে ক্লাস ডিঙোতে ডিঙোতে মুখের ছবি দেখতে শুরু করলাম ...মার,বাবার, ছোটমার অস্থির মুখের ছবি সব ...’ও মণি,তোমার বাপেরে এট্টু মুড়িটা দে আসবে,মণিমা র একঢাল চুলের ছাওয়া মুখেতোর ছোটমা কই?’ বাবার গলা গম্ভীর।কাজ করছে’...এমনটি ছবি হতো প্রায়দিন। জ্যোৎস্নামাখা ছাদের আলসেতে পিঠ ঠেকিয়ে বসতো ছোটমা,,পা ছড়িয়ে শাড়ি উঠে পা বেড়িয়ে থাকতো খানিক,আমার কেমন সাদা পদ্ম র মতো লাগতো পাঠশালার পাশের দিঘিতে দেখেছি সাদা পদ্ম...ভালোবাসা র স্বাদ কেমন,আর জেবনে জানা হলো না মণি, তোমারে সন্তান মানি রে বাপ, বুকের দুধ তো আমার ওমনিই ফেলা যেতোতুমিই আমারে ধন্যি করে রেখে দিলেছোটমাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। আমারই শুধু চোখ কড়কড় করতো ছোটমার ভেসে যাওয়া গলা শুনে। হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে গেলো মাঝরাতে মার তীব্র স্বর খানখান হয়ে যাচ্ছেঘর,দালান,উঠান,ছাদ,আকাশ ...মরে যা,মরে যা আবাগীর বেট, মরে যা তুইএক ধামা রূপ নিয়ে ঘুরঘুর করিস কি করে রে,লুকিয়ে,লুকিয়ে মাছ,দুধ খাস তুই জানিনা ভেবেছিসএতো তেলনো শরীর কি করে হয় রে তোরআমিই ওই চুল কেটে মাথা যদি না মুড়াই তোর ! নিজের বর ,ছেলেকে খেয়ে আমার গুলোর দিকে নজর দিস ... মরে যা...মরে যাসকালে কোথ্থাও খুঁজে পেলাম না ছোটমাকে। আমি একা একা খেলাম। একা চুল আঁচড়ালাম। পাঠশালায় গেলাম। বিকালে বাড়ি আসতে শুনলাম আমাদের মুনিশ মহিমকে পাওয়া যাচ্ছে নাবাড়ির চারিদিকে ফিসফাস - মহিম আর ছোটমা ছোটমা আর মহিম মহিম আর ছোটমা ... বাবা বাঘের মতো পায়চারি করছে উঠানেরাগে গনগনে মুখ মা পাথর নিথরবাবা হন্যে হয়ে লোক লাগালো,কুকুরের মতো খুঁজে মহিমের মাসির বাড়ি থেকে তুলে আনলো ছোটমাকে তারাসাতদিন বাদে আবার পা রাখলো উঠানে ছোটমা। নাপিত এসে মাথা মুড়িয়ে দিলো। মা ডেকেছিলো তাকে। কোনো সালিশি সভা বসলো না। বাবাই তো প্রধান। সব মুখে কুলুপ আঁটলো।মহিমকে ভালোবাসলে ছোটমা?’ ’জানিনে মণি,শুধু রাত্তির দিন তার চওড়া বুকের পাটাখান ভাসে’ ’মহিম কোথায় ’? ’জানিনে বাপ তুমি আমার থেনে পনেরো বছরের ছোট, তবু বোজো সব তোমারে ছেড়ে যেতে কলজে ছিঁড়ে গেছলোহেই সংসারডা আপন হলো না মণি নষ্ট হয়ে রইলুম ছাইপাঁশের মতোহ্যারিকেন জ্বালিয়ে উঠলো ছোটমা, সন্ধ্যা নামলো পুকুরঘাটে যাবেইলেকট্রিক এসে গেছে বাড়ির ভিতরপুকুরঘাট অন্ধকারজলে ডুব দিয়ে স্নান করবে ছোটমা, আমি ছবি দেখি ছোটমা কাঁদবে একলা একলাআস্তে আস্তে পকুরটা একদিন কান্না-পুকুর হয়ে যাবে ... জলের স্বাদ হবে নোনাহবেই