গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শীলা ঘটক

সংসার সায়াহ্নে 

সুপ্রিয় দরজাটা বন্ধ করে দাও তো, খুব হাওয়া দিচ্ছে......বেলা হয়ে যাচ্ছে, কাজের মেয়েটাও তো এখনও এলো না। 

নন্দিনী কথাগুলো বলে দোতলার ঘরের দিকে চলে গেল। সুপ্রিয় আর নন্দিনী এই বাড়িটায় এখন দুজন বাসিন্দা। ছেলে রণ দশবছর হয়ে গেল আমেরিকায় থাকে। রণ একজন ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী দিশা আর ছেলে জয় কে নিয়ে ওখানেই থাকে। তিন/চার বছর অন্তর কোলকাতায় আসে, মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে। প্রায় রাতেই কম্পিউটারে ভিডিও কনফারেন্স এ কথাবার্তা হয়। যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক গুলো কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে ! কম্পিউটারের আলো নিভে গেলে নন্দিনী কম্পিউটারের স্ক্রীনের ওপর হাত বোলাতে থাকে। সুপ্রিয় বুঝতে পারে নন্দিনীর  মনের অবস্থা ............
চলো খাবে না? অনেক তো রাত হলও মেয়েটা কখন রান্না করে গেছে, খাবে চলো নন্দিনী নন্দিনী এখন ষাটের কোটায় আর সুপ্রিয় এখন সত্তর। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক বিশাল বাড়িতে জনমানব শূন্য পরিবেশে এই দম্পতির কালযাপন।

ছোটবেলায় রণ যখন স্কুলে পড়তো নন্দিনী তখন এক সরকারি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা আর সুপ্রিয় তখন তার ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। দুজনেই তখন খুব ব্যস্ত যার যার কাজ নিয়ে...... রণ তখন নিঃসঙ্গ বলা যেতে পারে। স্কুল শেষে একাকী সময় কাটে তার। একদিন দার্জিলিং এর নর্থ পয়েন্ট স্কুলে রণ কে ভর্তি করে হোস্টেল এ রেখে এলো ওরা। টাকার অভাব নেই, ভালো জায়গায় থাকলে ভালোভাবে মানুষ হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে অসুবিধা হবে না। দেশে যদি নাও হয় বিদেশে তো  হবেই।  কিন্তু মা-বাবাকে ছেড়ে হস্টেলে যেতে রণের খুব কষ্ট হয়েছিল! কচি বুকের পাঁজরে অনুভব করেছিল মোচড় দেওয়ার ব্যথা!, কিন্তু সেই ব্যথা বাবা-মা কেউ উপলব্ধি করতে পারল না। জামাকাপড়, বইখাতা, সাজ-সরঞ্জাম সব কিছু দিয়ে রেখে এলো নর্থ পয়েন্ট স্কুলের হোস্টেলে।

বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে আসছে কোমর। হাঁটতে চলতে বেশ কষ্ট হয় নন্দিনীর। সুপ্রিয় বেশীর ভাগ সময় নিজের ঘরে ব্যবসার কাগজপত্র দেখাদেখিতে ব্যস্ত থাকে। সময়টা যেন কাটতেই চায়না। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ঝুল বারান্দায় বসে থাকে নন্দিনী, ভাবতে থাকে...... ওরা তিনজন যদি এখানে থাকতো, কি ভালোই না হতো! বাড়িটা ভরে উঠত আনন্দে...... ‘ওকে আমেরিকাতে না যেতে দিলেই মনে হয় ভালো হতো। ছোট থেকে ছেলেটা আমাদের ছেড়ে হোস্টেলে থেকে বড়ো হল, যখন বড়ো হল পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে পাড়ি দিল, তারপর ওখানকার এক প্রবাসীর মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতে বসলো! প্রায় ছয় বছর হয়ে গেল এখানে এসেছিলকথাগুলো নন্দিনী বলতে থাকে।
রাত বাড়তে থাকে_____ স্মৃতির খাতার পাতা উল্টোতেই থাকে নন্দিনী। রাস্তাটা একেবারে নির্জন হয়ে গেছে, একটা/দুটো গাড়ি আসছে যাচ্ছে, আনমনা চোখ দুটো বিষাদ থেকে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করে___ কিন্তু খুঁজতে চাইলেই কি পাওয়া যায়!  কখন যে সুপ্রিয় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে নন্দিনী বুঝতেই পারেনি, কাঁধে হাতটা দিতেই ফিরে তাকায়, ‘ওহ তুমি/ কখন এলে?’
এইতো এখনি ...... ঠাণ্ডা পড়ছে___ কতক্ষণ আর বাইরে বসে থাকবে, চলো ঘরে চলোনন্দিনী ইজিচেয়ার ছেড়ে ঘরে চলে যায়। সুপ্রিয় বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দেয়।  রাত অনেক হয়েছে, চলো খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া যাক
জানো আমার আর ভালো লাগে না, সারাদিন সময়টা কাটতেই চায় না। জয়টা যদি এখানে থাকতো দৌড় দৌড়ই, লাফালাফি____ কি ভালোই না হতো!’
ওসব ভেবে লাভ নেই, ও তো ওর মা-বাবার কাছে থাকবে , নাকি আমাদের কাছে থাকবে?’

এবার পুজোয় রণ তার পরিবার নিয়ে কোলকাতায় আসবে, মাকে ফোনে জানালো।
ওগো শুনছো রণ, দিশা, জয় সবাই এবার পুজোয় কোলকাতা আসছে___ উফ আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলবো’......... নন্দিনী ফোনটা রেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সুপ্রিয় কে জানায়। সুপ্রিয়র ঠোঁটের কোনে হাসি, ‘ যাক অনেকদিন পর আবার আমরা একসঙ্গে হবো, পুজোর দিনগুলো কিভাবে যে কেটে যায় বোঝাই যায় না বলো
হ্যাঁ ঠিক বলেছ, একেবারেই ভালোলাগে না। শোনো একদিন শপিং এ যেতে হবে। তোমার কবে সময় হবে বলতো? ড্রাইভার কে বলে দিও অনেকক্ষণ সময় লাগবে কিন্তুসকালবেলার ফোনটা সারাদিনের রোদের  ঝলমল ভাবটা যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
আগামী পরশু যাব শপিং করতে শুনতে পাচ্ছ?’ _____ আনন্দে উত্তেজনায় নন্দিনীর গলার স্বরটা যেন একটু বেশী জোর শোনাচ্ছে ।
দুকাপ গ্রীন টি নিয়ে দুজনে বারান্দায় এসে বসল, ‘ কি গো দাদুভাই আসবে শুনে খুব ভালো লাগছে তাই না? সেই ছয় বছর আগে এসেছিলো এখন কতোটাই না  বড়ো হয়ে গেছে!’ সুপ্রিয় নন্দিনীর দিকে তাকায়_____ ‘এত উত্তেজিত হয়ো না, তোমার বয়স বাড়ছে, প্রেসার বাড়বে, একটু সাবধানে চলাফেরা করো
তোমার মুখে শুধু অলক্ষণে কথা, ওরা কতদিন পর আসছে বলতো!’
জানিতো......’
আমার আর তর সইছে না বাপু, যাই বলো

সারাদিন দুই বৃদ্ধ মা বাবা প্রহর গোনে কবে ছেলে, ছেলের বউ, নাতিকে দেখতে পাবে।
ছেলেটাকে বিদেশে না যেতে দিলেই মনে হয় ভালো হতো_____ তাহলে আমাদের দিনগুলো এইরকম একা একা কাটতো না বলোবিছানায় শুয়ে শুয়ে নন্দিনী কথাগুলো বলতে থাকে। সুপ্রিয় বার্থরুম থেকেই উত্তর দেয়, ‘ রণ কে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যাপারে আমার কিন্তু খুব আপত্তি ছিল ... তুমি আমার কথা শুনলে না।স্কুলের চাকরিটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলে। তখনই বলেছিলাম ব্যবসায় যা লাভ হচ্ছে তা মন্দ নয়, বরং ভালোই বলা যায়। কিন্তু তোমার ঐ এক গোঁ চাকরি তুমি করবেই। সেই ছেলেবেলা থেকে ছেলেটা আমাদের ছেড়ে বাইরে রইল। আমার এটা ভালো লাগেনি
সারাজীবন এই এক কথা আমাকে শুনে যেতে হবে, আমি জানি’.........
না না কথা শোনানোর জন্য বলছি না। ছোট থেকে মাবাবাকে ছেড়ে থাকতে থাকতে আমাদের প্রতি টানটা কি বস্তু সেটা রণ কোনদিন উপলব্ধি করতে পারল না। পড়াশোনা শেষ করে কটা দিনই বা বাড়িতে রইল বলো...... ইঞ্জিনিয়ারিং এ  স্কলারশিপ নিয়ে সেই যে আমেরিকা গেলো _____ ওখানেই চাকরি তে জয়েন করলো

নন্দিনীর চোখ দুটো জলে ভরে ওঠেওখানেই ফ্ল্যাট কিনে নিল, মা বাবার কথা  একবার ভাবল না! ছেলেটা খুব স্বার্থপর হয়েছে জানোনন্দিনী বলতে থাকে.........
মুখ, হাত মুছে সুপ্রিয় পাশে এসে বসে_____ ‘স্বার্থপর তো আমরাই করেছি, তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? যখন ওর আমাদের বেশী দরকার ছিল, তখন আমি ব্যবসা আর তুমি স্কুলের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, ওর ছোট ছোট আবদারগুলো কোনদিন মেটানোর দরকারই মনে করিনি আমরা!’  নন্দিনীর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে।  
              
ড্রাইভার দুলাল গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে...... ‘মা, আমি এসে গেছি, আপনারা নিচে আসুন
হ্যাঁ দুলাল যাচ্ছি’......... নন্দিনী ওপর থেকে কথাগুলো বলে।
নন্দিনী আর সুপ্রিয় কে নিয়ে দুলাল সাউথ সিটির দিকে রওনা হয়________ গাড়িতে যেতে যেতে নন্দিনী বলে, ‘দেখো  ওদের জন্য পাঁচটা করে সেট কিনবো। পুজোর পাঁচদিনে সব জামাকাপড় আমি কিনে রেখে দেব

রণর স্ত্রী শাড়ি পরে না, ওর জন্য জিনস, টপ, সালোয়ার আর রণ ও জয়ের জন্য ড্রেস কিনল।
বাড়িতে ফিরে খুব আনন্দ হচ্ছিল নন্দিনীর। রাতে ভিডিও কনফেরেন্সে নন্দিনী পোশাকগুলো ওদের দেখালো। জয় খুব আনন্দ পেল ড্রেসগুলো দেখে, দিশার ও খুব পছন্দ হয়েছে...... বলল, ‘ভারি সুন্দর হয়েছে মা!’ রণ বলল, ‘ এত কিছু কেনার কি কোন দরকার ছিল মা’ ......
আজকের রাতটা খুব ভালো লাগছে!_____ ওদের পছন্দ হয়েছে দেখে। বিভিন্ন কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। এখন শুধু দিন গোনার পালা, ওরা পুজোর পঞ্চমীতে এসে পৌঁছাবে। প্রচুর কাজ এখন, ভীষণ ব্যস্ততা, কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখতে যাবে, কি কি রান্না হবে ...... এইসব নিয়ে ভাবতে থাকে নন্দিনী, ঘুমই আসতে চায় না______

আজ মহালয়া। ভোর চারটেতে উঠে পড়েছে দুজনে। দুজনেই মহালয়া শুনতে ভালো বাসে, এত বছরে একবারও বাদ যায়নি মহালয়া শোনা। দিনগুলো যেন কাটতেই চায় না_____ ‘ওগো শুনছো’ ____ সুপ্রিয়কে নন্দিনী বার বার ডেকে ওঠে, এতদিন পর নন্দিনী কে এতটা উৎফুল্ল দেখে মনে মনে খুশী হয় সুপ্রিয়একমাসের ছুটিতে আসছে। নাতি এখন একটু বড়ো হয়েছে।সুপ্রিয় ওকে নিয়ে রোজ মর্নিং ওয়াক করার কথা ভাবে, প্রকাশও করে ফেলে নন্দিনীর কাছে ।
না না রোজ সকালে ওকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাবে না, ওর কষ্ট হবে। দাদুভাই আমার কাছে থাকবে, আমি ওকে চোখের আড়াল করতে পারবোনা’_____ একনিঃশ্বাসে নন্দিনী কথাগুলো বলে যায়।

মহালয়া শুনে একটু বেলা হতে দুজনে সকালের জলখাবার নিয়ে টেবিলে বসে, এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। নন্দিনী তাড়াতাড়ি উঠে যায় ফোন ধরতে ____
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো নন্দিনীর কোন শব্দ না পেয়ে সুপ্রিয় জিজ্ঞেস করে, ‘কার ফোন? কে ফোন করলো? কি হোল? তোমার খাবারটা পড়ে আছে____ নন্দিনী ই ই
একি তুমি কাঁদছকি হয়েছে? কার ফোন ছিল? কথা বলছো না কেন?’
ওরা আসতে পারবে না, রণের কাজের জন্য অফিস ছুটি বাতিল করেছে’...... কোনরকমে রিসিভারটা রেখে নন্দিনী বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে____ সুপ্রিয় উদাস চোখে জানলা দিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে......... আগমনীর গানে বাজে বিষাদের সুর।