গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ২৮ অক্টোবর ২০১৭

এই সংখ্যায় ৯টি গল্প । লিখেছেন - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, রত্নদীপা দে ঘোষ, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, নীহার চক্রবর্তী, অমিতাভ দাস, কাওসার পারভীন, তাপসকিরণ রায় ও অলভ্য ঘোষ ।

সম্পাদকীয়

গল্পগুচ্ছ ছয় পেরিয়ে সাতে পা দিল । এই সংখ্যাট গল্পগুচ্ছর সপ্তম বর্ষের প্রথম সংখ্যা । সেই কবে ১৪ই অক্টোবর ২০১১তে একটি মাত্র গল্প নিয়ে আমার নিজের লেখার ব্লগ হিসাবে গল্পগুচ্ছর প্রকাশ শুরু করেছিলাম । তারপর অচিরে সেটাই হয়ে গেল পাক্ষিক ওয়েব পত্রিকা । একটা ওয়েব পত্রিকার ক্ষেত্রে ছ ছটা বছর বড় কম সময় নয় । আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই এই ছয় বছরে ১০৭৭টি গল্প অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে গল্পগুচ্ছ, আর এই সময়কালে গল্পগুচ্ছর পৃষ্ঠা দর্শন করেছেন ২লক্ষ ৬৬ হাজার পাঠক ।


গল্পগুচ্ছর এই ছয় বছরের পথচলা সম্ভব হয়েছে তার লেখক, পাঠক  অগণিত শুভানুধ্যায়ীর শুভেচ্ছা ও সহযোগিতায় । তাদের অভিবাদন জানাই । ছ বছর আগে যে গল্পটি দিয়ে ‘গল্পগুচ্ছ’ তার যাত্রা শুরু করেছিল ২০১১র ১৪ই অক্টোবর, সেই ‘নীলমনি ও সত্যপ্রকাশ’ শিরোনামের গল্পটি এই সংখ্যায় পুণঃপ্রকাশ করলাম গল্পগুচ্ছর প্রথম দিনটির স্মরণে ।

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

(প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রথম গল্প)


নীলমনি ও সত্যপ্রকাশ

সত্যপ্রকাশকে নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ বা ইচ্ছে কিছুই ছিল না , বরং নীলমণিকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছিলাম । নীলমনি মহাতো পুরুলিয়ার এক গন্ডগ্রামের আদিবাসী লোকশিল্পী । আমি তখন রাড় বাংলার লোকগান নিয়ে একটা কাজ করছিলাম , সে কাজেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে যেতাম প্রায়ই  তখনই নীলমণির সঙ্গে আলাপ হয় । পুরুলিয়ার রুখা শুখা মাটি থেকে সুর তুলে আনত নীলমনী । ওকে একদিন বলেছিলাম কলকাতায় একদিন প্রাণভরে তোমার গান শুনবো নীলমনি । নীলমনি বলেছিলো, কলকাতার জলসায় আমি গান গাইবোনা, টাকা দিলেও না । বলেছিল, শহরে ইট কাঠের জঙ্গলে মানুষের প্রাণের মধ্যি কোনো সুর লাই গো দাদা । বলেছিল, ইদিকটা একতু শান্ত হোলি, এস আমার কুঁড়ে ঘরে বসে তোমায় প্রাণ ভরে গান শুনাবো ।
না, নীলমণি আর কোনদিন গান শোনাবে না  আজকের কাগজে ছোট করে একটা সংবাদ বেরিয়েছে , পুরুলিয়ার লোকসঙ্গীত  শিল্পী নীলমনি মাহাতো খুন হয়েছে, রাস্তার ধারে তার কন্ঠনালী কাটা লাশটা পাওয়া গেছে । কারা নীলমণিকে খুন করেছে তার ইঙ্গীতও সংবাদ পত্রটি দিয়েছে । এখন অবশ্য রাস্তার ধারে খুন হয়ে পড়ে থাকা লাশ কোন দুর্লভ দৃশ্য নয় । বিচলিত আমি ভেবে পাইনা বেঁচে থাকার জন্য মানুষ আর কত মূল্য দেবে ! কিন্তু নীলমণির এলাকা তো গান, সেই এলাকায় ঢুকতে তো মোটর সাইকেল চেপে আসতে হয় না !
       
ঠিক এই সময় আমার সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়বার ইচ্ছে হলো । ও কি আমার মতই বিচলিত হয়েছে ? নাকি বিচলিত হওয়ার মত মন এখনো ওর আছে !সত্যপ্রকাশ কলকাতার একডাকে চেনা নাট্য ব্যক্তিত্ব , মিডিয়া ইদানিং একটা অলঙ্কার লাগিয়েছে সেলিব্রিটি  তা সে আমার বন্ধুও বটে , অন্তত দু বছর আগে পর্যন্ত ছিল । শুনতে পাই এখন সত্যপ্রকাশ আমাকে দালালছাড়া আর কিছু ভাবেনা , তা ভাবুক, কিন্তু সত্যপ্রকাশের নাট্যবোধ ও অভিনয় দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখনো অটুট । ইদানিং অবশ্য সত্যপ্রকাশ থিয়েটারে আর সময় দিচ্ছে নয়া, এখন টেলিভিষণে ওর খুব চাহিদা, নানান কারেন্ট এফেয়ার্স ওনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনের মোমবাতি মিছিলেও দেখা যায় সামনের দিকে ।


বছর তিনেক আগে আমিই নীলমণিকে সত্যপ্রকাশের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । পুরুলিয়ার লোক শিল্পীদের জীবন নিয়ে রুক্ষ মাটির গান নামে একটা নাটক করার কথা সত্যপ্রকাশ আমাকে বলেছিল  নাটকটাতে সুর ও গান করার জন্য আমি নীলমণিকে রাজি করিয়েছিলাম  রুক্ষ মাটির গান দারুন হিট করেছিল  ও আমাকে বলেছিল যে এই নাটকটাই ওর সচেয়ে সফল প্রযোজনা এবং নীলমণির গানের জন্যই যে সেটা সম্ভব হয়েছল, সত্যপ্রকাশ তাও জানিয়েছিল  সেই নীলমনির খুন হয়ে যাওয়ার খবরটা সত্যপ্রকাশ নিশ্চয়ই পেয়েছে  আমি মনে মনে সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করতেই আর একটা দৃশ্য ভেসে এলো  নীলমনির জন্য নাটক ও সঙ্গীত জগতের লোকেরা মোমবাতি মিছিল করছে, আমি মিছিলে সত্যপ্রকাশের মুখটা খুঁজছি তন্নতন্ন করে 
          
আচমকা টেলিফোনের তীব্র শব্দে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। ফোন তুললাম  অবাক বিস্ময়ে শুনলাম ওপারের কন্ঠ – ‘মণীষ, আমি সত্যপ্রকাশ বলছি  আমার গলা দিয়ে আপাতত কোন শব্দ বেরোলো না  প্রায় দু বছর বাদে সত্যপ্রকাশ আমাকে ফোন করছে , ভেবে পেলাম না কি এমন ঘটনা ঘটল যে দালাল হয়ে যাওয়া আমাকে ওর দরকার পড়লো ? ওপারে কন্ঠে একটা আকুতি একবার আসতে পারবি’ ?
          
আমি ? কি ব্যাপার ? আমি জানতে চাইলাম । ও বললো, তোকে ছাড়া কাউকে বলা যাবে না  আমি বললাম, কিন্তু ব্যাপারটা কি তাতো জানতে হবে । সত্যপ্রকাশের কন্ঠস্বর একটু বিচলিত মনে হল, বললো, ‘হ্যা মানে সেই নীলমণি মাহাতো ...  জানি, গতকাল রাত্রে নীলমনি ......খুন হয়েছে কথাটা বলার আগেই সত্যপ্রকাশ বললো গতকাল গভীর রাতে নীলমণির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, ও আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল, আমি উত্তর দিতে পারিনি ।
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে নয়া, কি বলছে সত্যপ্রকাশ ? খুন হওয়ার তারিখে গভীর রাতে নীলমণি সত্যপ্রকাশের সঙ্গে দেখা করেছিল এ কি করে সম্ভব ? খবরের কাগজ তো জানিয়েছে নীলমণি রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে খুন হয়েছে , তা ছাড়া এদিন ই তো সত্যপ্রকাশের একটা সম্বর্ধনা অনুষ্টান ছিল , কোন এক মানবাধিকার সংগঠন ওকে সম্বর্ধনা দিচ্ছিল । দিনটা রবি বার ছিল , আমি সত্যপ্রকাশের ফ্ল্যাটে গেলাম ।
          
সত্যপ্রকাশ আমাকে যা বললো তা এই রকম । নীলমণির খুন হওয়ার দিন ওর ঘরে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়েছিল । সম্বর্ধনার পর খাওয়া-দাওয়া ছিল,পেটে একটু্ তরল পানীয়ও ঢুকেছিল  গলির মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছিল সত্যপ্রকাশ , হঠাত অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কালো মত লোক ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো - আমি নীলমণি মাহাতো বটে গো দাদা  চিনতে পারছো ? চিনতে পেরে সত্যপ্রকাশ বলেছিল , এত রাতে তুমি এখানে কি করে এলে নীলমণি ? তবে যে কাগজে দেখলাম ......, ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলমনি বলেছিল- ও কথা থাক দাদা, আমি একটা প্রশ্ন শুধোতে এইছিলুম গো । তুমিতো আমাদের ওখেনে মিটিন করতে গ্যাছিলে সেদিন , তা নীলমণি কেমন আছে একটুন খোজ করলেনা কেন গো দাদা ? একজন সুরের কারবারীকে খুন হতে হয় কেন গো দাদা ? সত্যপ্রকাশ চিৎকার করে উঠেছিল তাহলে খবরটা সত্যি ? তুমি ......! নীলমণি বলেছিল একটুন আগে তুমি যখন মিটিনে পুরুলিয়ার মানুষদের নিয়ে বলছ্যালে ঠিক তখনই তোমার নাটকের নীলমণি মাহাতোর কন্ঠনালী কাটা লাশটা ওরা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল । কেন গো দাদা, কোন বিপ্লবের দাম চুকোচ্ছি গো আমরা ?’ সত্যপ্রকাশের আর কিছু মনে ছিলনা । কখন কি ভাবে ঘরে ঢুকেছিল, তাও নয় 
          
বিবরনটা শুনে আমি আর একবার ওর ভেতরটা পড়বার চেষ্টা করলাম, কেননা মদের ঘোরে অন্তত নীলমণির কথা্টা ভেবেছিল সত্যপ্রকাশ , নীলমণির খুন হওয়াটা ওর ভেতরটাকে হয়তো কিঞ্চিৎ আলোড়িত করেছে । চলে আসার আগে বললাম, তুমি আবার রুক্ষ মাটির গাননাটকটা করো, নীলমণি না থাকুক, তার সুর আর গানগুলোতো আছে ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো টেলিফোনের শব্দে । ঘুম মাখা চোখে ফোন তুললাম । ওপারের কন্ঠ বল - যাদবপুর থানা থেকে সার্কেল ইন্সপেক্টর সুজয় বোস বলছি স্যার । শান্ত গলায় বললুম বলুনসুজয় বলল – ‘প্রবীণ নাট্যকার পরিচালক সত্যপ্রকাশ কাল রাত্রে আত্মহত্যা করেছেন, আপনি একবার আসতে পারবেন স্যার ? আপনাকে লেখা একটা চিরকূট রেখে গেছেনআমি আধঘন্টার মধ্যে পোঁছে গেলাম । সত্যপ্রকাশের মুখে গ্যাঁজলা ওঠা নিথর দেহটা পড়ে আছে, পাশে শূণ্য ঘুমের ওষুধের শিশিটা রয়েছে । সুজয় একটা চিরকূট বাড়িয়ে দিল । রাত্রি দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে লেখা একফালি কাগজে সত্যপ্রকাশ লিখেছে মণীষ, তোর কথাটাই ঠিক , বাঘের পিঠে ওঠাটা সহজ, নামাটা কঠিন , তাই ......
                                

রত্নদীপা দে ঘোষ

অন্তহীন


চোখে যেদিন প্রথম হাত রাখলে , পলক ফেলিনি ... বুকের আঁচল সামান্য অর্গল ... মেঘের ভেতর থেকে ... আগুনের ওপর থেকে ... অপেরার স্রোতে মজে উঠলুম । ভালবাসলুম তোমাকে অর্ণব ... বিশ্বাসের জবাফুল , কুসুমের ঘাসফুল  ... অতলান্ত সুখের দিন ... খুশবাগান ... সব সব তুমি-তুমি ...

সকালে ঘুম থেকেই উঠেই এই মেসেজ পেলেন ফেসবুকে । চিত্রশিল্পী অর্ণব দাশগুপ্ত ।

টুং টাং । সবুজ বাতি । অমোঘ তার আকর্ষণ । আবিষ্ট নন্দিন । এই নাম , এই নামেই সে ডেকেছে । অর্ণব । অনিবার্য এখন নন্দিনীর জীবনে ... ল্যাপটপ খোলা  । কফির কাপ মেলা । আলো আর অন্ধকার । নন্দিনও খোলা আর মেলা ...

দেরী কেন ? অর্ণবের আঙুল । টাইপ হচ্ছে স্বর । হাউ ম্যানলি । অর্ণবের কণ্ঠ স্পষ্ট শুঞ্ছে নন্দিনী । বর অফিস । মেয়ে স্কুল । অঢেল সময় নন্দিনীর হাতে । এখন অর্ণবের তুলির সামনে অনেক অনেকটা সময় নন্দিনী একা । একে একে উড়বে নন্দিনীর স্লিভলেস টপ । ক্যাপ্রি দুল্বে বাতাসের আকাশে । অর্ণবের ল্যাপটপের পাতায় নন্দিনী মেলে দেবে নিজেকে ...

লজ্জা ? অর্ণবকে লজ্জা ? রাম কহো । চার চারটি মাস । অর্ণব কি জানে না নন্দিনির ? ব্রেসিয়ারের সাইজ থেকে শুরু করে পিরিয়ডের ডেট সব অর্ণবের আয়নায় ... আরও অনেক কিছু জানে অর্ণব । এই যেমন সন্দীপন অর্থাৎ নন্দিনীর বর কি করে ? কখন অফিস । মেয়ে কোন ক্লাস । কখন স্কুল । কখন বাড়ি ফেরে , কোন ড্রেস বেশি পছন্দ । প্রাচ্য না পশ্চিম  ? ইত্যাদি প্রভৃতি ... সব অর্ণবের জানা ...

নন্দিনীও অর্ণবের সব সব টুকু জানে । অর্ণব বিবাহিত । কিন্তু তার স্ত্রী দরিদ্র চিত্রকর অর্ণবের সাথে থাকে না ।  বিদেশে থাকে কোথাও । ছেলে মেয়েও নেই । অর্ণবের জীবনে নন্দিনী । নন্দিনীই সব টুকু । আজ কাল পরশু । নন্দিনী ছাড়া অর্ণবের আর দ্বিতীয় ছায়াপাথ নেই । যাত্রাপথও নেই । নন্দিনী যতটা পারে অর্ণবকে সব সব ... দেওয়ার তো শেষ নেই । বন্ধুরা বলে , নন্দিনীরে তোর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ... আজ অব্ধি চেয়ে পাইনি এমনটি হয়নি ... তোর যেন দেবারই শেষ নেই ...

আজ তাড়াতাড়ি স্নান ? অর্ণব প্রশ্ন করেছে ।
নন্দিনী টাইপ করছে , যেন আঙ্গুল দিয়ে স্পরশ করছে অর্ণবের বুক । সাদা আর কালোয় মেশানো অর্ণবের বুক । মনে মনে মাথা রাখছে সেই বুকে । শ্বাস নিচ্ছে , গন্ধ নিচ্ছে ... খুব জোরে জোরে । অর্ণবের নিপলদুটো কী সাঙ্ঘাতিক শক্ত আর কালোরঙের বোঁটাসহ । মনে মনে চুষছে নন্দিনী । অর্ণব ও তাকে ? এইটুকু ভেবেই কেঁপে উঠলো ...

 ... তুমি ভুলে গেছ আজ আমি বেরবো , লেডিস ক্লাবে একটা গেট  টুগেদার আছে ? ফলোড বাই লাঞ্চ ? ...ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে নন্দিনী ...  অর্ণবের মনে পড়ছে ।  হুম ... আরে আরে , আমি তো একদম ভুলেই গেছি ... যেও যেও না , তুমি প্লীজ যেও না ... নন্দিন , মাই বেবি ... আই উইল মিস উ ...

না হবে না । আমায় যেতেই হবে । বিশ্বাস করো । যদি অ্যাভয়েড করা যেত আমি কি করতুম না । কিন্তু উপায় নেই গো । আমি যে গ্রুপ লিডার ...

না , তুমি আমার চিয়ার লিডার ... তুমি যাবে না আমাকে ছেড়ে ... আমি কাল রাত থেকে শুধু তোমাকে , তোমাকেই ভেবে ভেবে ...  ... ফুঁসে উঠছে নন্দিন , ঠিক নদীর মত গর্জে উঠছে বন্যার তড়ে ... কি বললে ? শুধু রাতেই আমাকে ভাবো ... সামান্য থমকেছে অর্ণব ... এটা তুমি আমাকে বলতে পারলে আমার সোনাটা ? কি করে পারলে তুমি ?

আরে বাবা , মজা মজা করছিলাম যে ... আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছে মৃদুবায় ... তাহলে একবার খোলো ... যাবার আগে একবার খোল ... তোমার বুকে একবার মাথা রাখতে দাও ্‌, প্লীজ ... তোমার বুকদুটোই আমাকে পাগল করে দিয়েছে ।। আমি ঘুমোতে পারি না ... তোমার বুকে একবার অন্তত দিনে ঠোঁট না রাখলে আমি ছবিও আক্তে পারি না ...

প্লীজ ... আজ কোন রঙের ব্রেসিয়ার ...বলো বলো  

আজ কালো ... আজ ভয়ঙ্কর পাথুরে কালো রঙ ঘিরে রেখেছে আমার বুক ... দুষ্টুমির হাসি  ... খুলে দিয়েছি ... খুলে দিয়েছি ... আমাকে খাও ... ... আই লাভ ইউ অর্ণব ... পাগলের মত ভিজে ভিজে  , ভেসে ভেসে উঠছে অর্ণবের তুলিতে ... উথলে উথছে ল্যাপটপ ...

পিঁপড়ের মত খুদে খুদে অক্ষর বহু সম্ভাবনার অরগাজমক্ষেত্রটি । ফুলে ওঠা ফুল ফল আর প্রকৃতির যৌথভাণ্ডার , ... না , আজ আর নয় ।। দেরী হয়ে যাচ্ছে  ... তুমি কি বিকেলে দিকে অন লাইন হবে একবার ? অর্ণব পড়তে পারছে নন্দিনীর অনিচ্ছুক সুর ... নন্দিনীর যে যাবার ইছছেই নেই ... অর্ণবকে ছেড়ে যাবার ইচ্ছে একেবারেই নেই ...

একবার স্বান্তনার জিভ । নন্দিনীর গলায় বুকে ... ভি ক্যামে ফুটে উঠছে দুই বুকের মাঝখানে এক বিঘত জড়ুল ... মেটে রঙের ...এক্কেবারে মাটির ঘ্রাণ এই মশরীরে । কবচে কুণ্ডলে তো বটেই ... সবুজ বাতি নিভে গেল ... অর্ণব দাশগুপ্ত নিজের তুলিটি নিজের হাতে চেপে ধরলেন ...


তারপর জোর করে নিভিয়ে দিলেন আগুন ... এইবার  বেজে উঠবে অ্যাক্রেলিক। তুলির অক্ষরে ভেসে যাবে রমণতৃপ্ত গাঙ্গেয় উৎসব ।অর্ণব এখন আঁকবেন নন্দিনীর রূপ রস গন্ধকাম  ...
এমনিতে খাবার হিসেবে অর্ণব পছন্দ করেন বিলো থার্টি ... সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ ।  বেশ জ্বলে ওঠা যায় । নিভে যাবার আগে  নিভে যেতে হয় না ... আর নন্দিনী ? চল্লিশ ছুঁইছুঁই  ... পৃথুলা হয়ে যাবার বয়েস ... তবে মান্তেই হবে ... বুক দুটো চরম উত্তেজনাপ্রবণ .. এবং প্রখর দ্যুতিময় ... ব্রেসিয়ারে আটকে রাখা যায় না সেই সামুদ্রিক কুহেলিকা ... সেই কুলুকুলু ডাক কীভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন অর্ণব  ...

দেখলেই দাঁড়িয়ে ওঠে আর টগবগ লাফাতে চায় অর্ণবের ঘোড়া ... যতক্ষণ না ... ঝাঁকি দিয়ে বেরোচ্ছে ক্যানভাস ... তখন কি আর অই বয়েস টয়েস খেয়াল থাকে ... ফেলো তক্তা মারো পেরেক ... প্রায় চল্লিশ নন্দিনী তখন অনায়াস নন্দিনে বয়ে যায় । অর্ণব   দাবাড়ু । চালে কখনো মাতাল হন না ... তবে ফুলন্তবুক দেখলে তিনি বেতাল অবশ্য হয়ে যান ... নন্দিনীর বোঁটার বদলে তুলিটাই কামড়ে ধরেন অর্ণব ...

 নন্দিন ... নন্দিনী ... একটু একটু ... আদর দাও আমায় ... বড় তেষ্টা ... অপার ...

লেডিস ক্লাবে নন্দিনী লাল শাড়ি । পাল্লা দিয়ে নীল ব্লাউজ । ব্লাউজ তো নয় , ছত্ত্রিশ সাইজের ঢেউ । মফচেন । নাভি তে স্পর্শ ... কোন সে পুরুষ ... কোন কথাতেই মন লাগাতে পারছে নন্দিনী রয় ।
... চিন্তায় মেঘ ...অন্ধকার চিত্ত ... আলো ... আলো ... অর্ণব অর্ণব আলো দাও আমায় ...

নন্দিনী এখন খুলে নিচ্ছে নিজের দেশ মহাদেশ ছোট বড় পাহাড় । নদী বিছিয়ে দিচ্ছে সমস্ত অনুশাসন খুলে । আহা জীবন্ত ভাণ্ডার ... রতিগাছ ... ফুলছাপ ব্রাপরাগ .. উড়ে যায় । যাক সব । কিন্তু অর্ণব ?



অর্ণব সেন চোখের সাথে পাল্লা দিয়ে তুলি আঁকছেন । এই সিরিজে মোট কুড়িটি ছবি । কুড়িটি ছবিই বছর চল্লিশের নারীস্তন । স্তনের ওপর থেকে আকর্ষণ কিছুতেই যায় না । তেষ্টা মেটে না কিছুতেই । চেষ্টা করেও । তাই বয়েসের ক্রম হিসেবে এই সিরিজটি শুরু করেছেন তিনি । এই মাস চারেক ধরে কাজ চলছে । প্রথম পর্যায়ে তিনি বেছে নিয়েছেন ...  প্রায় চল্লিশের নারী স্তন । দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হবে তিরিশ বা প্রায় তিরিশ । আর তৃতীয় পর্যায়টি কুড়ির কম । এই প্রতিটি সিরিজ হবে এক বিশেষ কারুকাজের উপহার ।

প্রায় চল্লিশ ... এই গ্রুপটির জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন নন্দিনীকে । ফেসবুকের একটি সেলফি ... বুক অব্ধি ... নন্দিনীর সেই সেলফি দেখেই প্রথম এই সিরিজটির কথা মাথায় আসে অর্ণবের । কী অপূর্ব বক্ষদুটি । বুকভরা । পাগলকরা যৌনতায় বোঁটাদুটি ফুটে । লালহাল্কা ক্রমশ ফিনফিনে ... আর চন্মনে ... বেহালার শেষ ছড় দিতে দিতে অর্ণব আরেকবার চুষে নিলেন নন্দিনীর ক্যানভাস ...

নন্দিনীকে কাছে পেতে ক দিন সময় লাগলো অর্ণবের ?

হা হা হা ... সাত দিন ও নয় ... মেয়েরা কত ইডিয়ট হতে পারে ... হা হা হা ... নিজের কাঁচা পাকা চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিলেন অর্ণব ... গুনে গুনে সাত দিন ... অর্ণব একের পর এক ছবি আঁকলেন ... নন্দিনীর । পাঠালেন ইনবক্সে । নন্দিনী ... আহা সেই কোমলতরু নন্দিনী বিশ্বাস করে নিল , অর্ণব তার একমাত্র প্রেমিক এই ফেসবুকে ... নন্দিনী ফেসবুকে ছবি দ্যায় । আর তুরন্ত সেই ছবি এঁকে ফেলেন অর্ণব । আর বিদ্যুৎবেগে সেই ছবি পৌঁছে যায় নন্দিনীর ইনবক্সে ... আর তার ন দিনের মাথায় , অর্ণবকে ইনবক্স করে নন্দিনী ... ভালবাসি । আমিও তুমুল ভালবেসেছি তোমায় ...

বারোদিনের মাথায় নন্দিনী এলো ওইয়েবকামে । কেন এলো ? সে তো সেক্সক্ষুধার্ত নয় । শক্তপোক্ত স্বামী আছে তার । তার তো খিদে থাকার নয় । সে কেন আসবে , খুলবে নিজেকে অন্যপুরুষের কাছে ? তবু সে এলো ...

অর্ণব একটি চাল টিপেই বুঝতে পারেন , ভাত শক্ত না নরম ? ইমোশনাল মানুষদের নিয়ে খেলা করা সব চাইতে সহজ ... হা হা হা ... ভালবাসি শব্দটাই এইরকম । নরম মনের মানুষদের অ্যাক লহমায় ভিজিয়ে দ্যায় । অর্ণব সেটা ভালই জানেন । কম শরীর তিনি ঘাঁটেননি ।... প্রথম দিনেই বুঝে গেলেন , নন্দিনীকে দিয়েই কাজ হবে । পয়সা ফেললে নারী অনেক পাওয়া যায় ।। কিন্তু নন্দিনীর মত নারী দুর্লভ । মা দুর্গার মত শরীরী জৌলুস তার ... নন্দিনীর আতসবাজি অর্ণবের চাই চাই চাই । আর দ্বিতীয় কোন কথা নেই ... প্রতিটি দিন ...  প্রতিটি ঘণ্টা নন্দিনীর ইনবক্সে ছায়ার মত ঘিরে থেকেছেন ...

অবশেষে এলো সুদিন । রাজকোষ  খুলে দিলো নন্দিনি । মাথা উঁচু । সূচালো । অপরূপ আকৃতি । আর এক আশ্চর্য জড়ুল । প্রথমে সেই জড়ুলে আঙ্গুল বলালেন অর্ণব । তারপর ।। তারপর জিভ । কেঁপে উঠলো নন্দিনী ... উগ্র তাণ্ডবনাচ । লাগাতার ... দিনের বেলায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নন্দিনীকে খাওয়া দাওয়া আর রাতে ছবি আঁকা । তিনি দুরন্ত টারজান ... নন্দিনীর সাথে পাতালেন অরণ্য । নন্দিনীর বুক ... সেই বুক কখনো আপেলশোভাময় ।। দুর্দান্ত পাহাড় ..কখনো পৃথিবীর সাথে জলসায় নেমেছে . কখনো পেল্লায় দুধঝর্না ... পৃথিবীর তাবৎ যিশুকে স্তন্য পান করাচ্ছে ... । কখনো নন্দিনী নিজেই এক বেতলাহরিণ ।বন্যবাঘের মুখে বুটি জড়িয়ে ধরছে ... দুর্দান্ত দুর্দান্ত এক একটি ছবি ...নগ্নমগ্ন নন্দিনীকে খেয়েও তিনি এতটা তৃপ্তি পাননি যতটা পেলেন নন্দিনীকে এঁকে ...


সন্ধ্যেগুলো কাটতে চায় না আর । সন্দীপন ফেরে ন’টার পর ... নন্দিনী কি যে করে ... কি করে ... মেয়ে পড়াশুনো নিয়ে । কাঁহাতক ফেসবুক আর হাইক ... ফেসবুকেও আর সেই টান নেই ... বিষাদ বিবশ ... নন্দিনী টিভি রিমোট ... ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ... গ্রিন টি সিপ করে করে ... চোখ আটকেছে । আটকেছে । নন্দিনীর চোখ আর কান দুটোই তার বশে আর নেই ... শরীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে স্টার আনন্দের পর্দায় গিয়ে আটকেছে ...

স্ক্রিন জুড়ে জলকালারে আর তেলরঙ্গে ফুটছে নারীস্তন । জোরালো । বোঁটা সহ ... একের পর এক ... দুটি বুকের মাঝখানে সেই জড়ুল ।। অনন্ত  আষাঢ় যেন দুটি বর্ষার ফাঁকে ... স্বয়ং চিত্রকর ও পাশে বসে আছেন ...

সংবাদিকের প্রশ্ন  ... এই জড়ুলটি বড়ই অদ্ভুত ... এমনটি দেখা যায় না ... কোথা থেকে এই আইডিয়াটি পেলেন ... যদি আমাদের একটু শেয়ার করেন ... সহাস্য উত্তরও দিচ্ছেন অর্ণব ।

‘আহা এই জড়ুল ? এই তো আমার এই চিত্রনটের থিমসং... এ আলাদীনের প্রদীপ ... আমার সমগ্র ছবিজীবনের জয়টীকা ... গত চারটি মাস এই রামধনু আমার কপালে ছিল আঁকা ... আসলে কি জানো ... এই সৌন্দর্য আমি স্বপ্নে পেয়েছি । সম্ভবত ঈশ্বরের বরদান ... এই সুতীব্র বিদ্যুৎ আসলে আমার কল্পনার সোনার কাঠিতে জড়ানো ... রূপার স্বর্ণকুম্ভ ... ‘’

নন্দিনী দেখছে অর্ণব । নন্দিনী শুনছে অর্ণব । ঘাম ... ঘাম ... নন্দিনের প্রিয়তম এ নাম । নন্দিনীর বুক খোলা বুক আজ টিভির পর্দায় ... অপূর্ব তার মাটি-মাটি জ্যোৎস্না ... নন্দিনী গন্ধ পাচ্ছে স্পষ্ট ... কার গন্ধ ? ঘ্রাণই বা কার ... অর্ণব ? নন্দিনীর ? না যৌথতার ... না যৌনতার ?
নন্দিনী টপ খুলে ফেলছে ... ব্রা খুলতেই ঝলসে উঠছে জোড়া বুক । দুই বুকের মধ্যে সাঁতরে উঠলো সাঁতার । টপলেস নন্দিনীর বুকের ছবি । জড়ুল সহ ... সেলফি । বুকের শুরু থেকে শেষ অবধি । ঠিক যেখানে উথলানোটা শেষ হয়েছে ততদুর । এই ছবিটা এবার উড়বে ।। ঠিক পাখির স্বরে ... কোন লজ্জা ভয় নেই ... সমাজের ভয় ... আর কি কিছু হারাবার আছে ? ... এই বুক থেকেই দুধ পান করে এত বড়টি হয়েছে কন্যা ...লজ্জা কিসের ...

এই বুকের ছবি এঁকেই তো অর্ণব দাশগুপ্ত । কত পুরষ্কার । কত সম্বর্ধনা । কত নাম ডাক ।
নন্দিনীর বুক । নন্দিনীর নিজস্ব জড়ুল । অথচ নন্দিনী ডাকনামে ... ডার্করুমে ... কেন অন্ধকারে থাকবে নন্দিনী ? কিসের ভয় ? আর কেনই বা ...

হা হা হা ... কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাসিতে নিজেই জড়িয়ে যাচ্ছে নন্দিন ... সেই হাসি কান্নার ছটায় চমকে উঠছে পোষা জড়ুল ... বহুদিন হয়ে গেছে ... এখানে কেউ ঠোঁট  ... এখন কেউ ঠোঁট ...

স্টার আনন্দের পাতা জুড়ে নন্দিনী । সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিজয়িনী নন্দিনী ... কোথায় সেই জড়ুল ... প্রিয় জন্মদাগ ... তুমি সামনে এসো ... ব্লাউজের দরজা কেটে বেরিয়ে এসো ... ছল আর প্রতারণার জানলা খুলে বেরিয়ে ...

বেরিয়ে আসছে জড়ুল । ভুল ভ্রম আর লজ্জাপর্ব ছুঁড়ে ...

বন্ধুরা বলে , নন্দিনী লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ।তার কাছে কিছু চেয়ে পাওয়া যায়নি এমনটি কখনো হয়নি ... মা বলে আমার ছেলের চাইতে মেয়ে অনেক বেশী সাহসী আর মাথাউঁচু ...
আর নন্দিনীর মেয়ে ?

সে বলে ... আমার মা অন্তহীন ...





ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ক্লাউন 

ক্লাসে ঢুকেই দেয়ালে টাঙ্গানো ব্ল্যাকবোর্ডে একটা মানুষের মুখ এঁকে ফেললেন মাষ্টারমশাই। সেদিন ক্লাসে পড়া বিশেষ ছিল না, তাই এইসব গল্প-ছবি আঁকা। মানুষের মুখটা এঁকেই বলে উঠলেনএই ধরো, এটা একটা ক্লাউন!
আমার তখন ক্লাস সিক্স। কিছুদিন আগেই মা-বাবার সঙ্গে গিয়ে সার্কাস দেখে এসেছি। তাই বলে উঠলামমাষ্টারমশাই, নাকের ডগায় একটা আপেল লাগানো থাকে, আর গাল গুলো সাদা হয়।
মাষ্টারমশাই আমার দিকে চেয়ে অল্প একটু হাসলেন
,বললেনওসব কিছু না থেকেও ক্লাউন হওয়া যায়। আজ তোমাদের একটা ক্লাউনের গল্প বলি। ক্লাউন কাকে বলে জান তো?’
 
আমরা সবাই খুব জোরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। মাষ্টারমশাই বললেন
ক্লাউন শুধু অন্যকে হাসায় তা নয়, সে এমন কিছু উল্টোপাল্টা কাজ করে, তাই দেখে, ভেবেও মানুষ হাসে। নিজে নিজেও হাসা যায়, হাসতে হয় অনেকসময়। আমাদের মানুষের মধ্যেও অনেক ক্লাউন আছে।
মাষ্টারমশাই সেদিন নিজের কথাই বলেছিলেন, অনেকদিন পর সেটা বুঝেছিলাম। বলেছিলেন,  একটা সোজা রাস্তায় চলতে চলতে কিছুটা পথ কি সুন্দর ভাবে সহজ পথে এগিয়ে গিয়ে আর  একটা পথ দেখে নাকি তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই রাস্তাটাও যে খুব খারাপ ছিল তা নয়,  কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আগের টাতে গেলেই তো হত। সবচেয়ে মুশকিলের কথা, দ্বিতীয় রাস্তাটা কিছু দুর গিয়ে কেমন যেন কাঁটাঝোপে ভর্তি আর এবড়ো-খেবড়ো । তাই পাশ দিয়ে  আরো একটা রাস্তায়  নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু অবাক কান্ড! আবার কিছু দুর গিয়ে দেখেন দ্বিতীয় আর তৃতীয় রাস্তাটা প্রায় একসঙ্গে মিশে গেছে, তার মানে সেই কাঁটাঝোপ আর এবড়ো-খেবড়ো। --আচ্ছা, তোমরাই বল, এর চেয়ে একেবারে প্রথম রাস্তাটাতে গেলেই হত। মাঝখান থেকে যাওয়াটাই আটকে রইল। এই যে কান্ড একে কি লোকে পাগলামো বলবে না? লোকে তো হাসাহাসি করবেই! আর কাকে দেখে লোকে হাসে, ক্লাউনকে দেখে, যে কিনা উল্টোপাল্টা কাজ করে। কি, ঠিক কিনা? আমার কাজটাও সেই ক্লাউনের মতই।এই বলে আমাদের দিকে চেয়ে রইলেন মাষ্টারমশাই।
সেদিন ঠিক মানুষের মধ্যে ক্লাউন আর সত্যিকারের ক্লাউন এই দুয়ের ফারাক বুঝিনি। কিন্তু মাষ্টারমশাই যে গল্পটা বলেছিলেন, সেটা অনেকদিন অবধি মনে ছিল।  

আমি তখন ক্লাস ইলেভেন, সবকিছু না বুঝলেও অনেককিছু বুঝি। বাড়িতে একদিন রন্টি দাদাকে মাষ্টারমশাইয়ের সেই গল্পটা বলেছিলাম। কেন এতদিন পর মনে পড়েছিল, তা বলতে পারব না। রন্টি দাদা আমার বড় পিসির ছেলে, আমাদের কাছে থেকে পড়াশোনা করত। একেবারে পাগল ছেলে। রন্টিদাদা গল্পটা শুনেই বলল---একেবারে আমার মতই। এই দ্যাখ্‌না,আমি ডাক্তারী পড়তে গিয়ে মনে হল, এর চেয়ে ইংরাজি নিয়ে পড়লে ভাল হত। ভর্তি হলাম নামী-দামী কলেজে। কিন্তু পড়া শেষ হতে না হতেই আমার মনে হল বটানি নিয়ে পড়লেই সবচেয়ে ভাল হত। বটানি নিয়ে পড়লে আমি কেমন ঝপাস করে গবেষণার কাজে লেগে যেতাম! কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তারীর থার্ড ইয়ার অবধি পড়া হয়ে গিয়েছিল, ওটাই তো আমার সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে সুবিধে ছিল, করলাম কি! আমাকে ক্লাউন ছাড়া আর কি বলা যায়? এখন যে আমাকে দেখে, সেই হাসে। 
রন্টি দাদার কথার মাঝে হঠাৎ দেখি ছোটপিসি কখন এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটপিসি এখানে একটা
 স্কুলে পড়ায়। রন্টি দাদাকে বলল---তুই আর ঝন্টিগিরি করিস না তো! সবই যেন ক্রিকেট, ঝপাস করে ঝন্টির ক্যাচ ধরা...!!
রন্টি দাদা বলে উঠলনয় তো কি তোর মত? জানিস মাষ্টারমশাই ...সেই কবে কি একটা ভালবাসা-টাসা হয়ে গেছে...তুই এখনও...কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি ছোটপিসি নেই। রন্টি  দাদা ছোটপিসিকে তুই বলে।
বললাম-- ছোটপিসি ...মাষ্টারমশাই...তার মানেরন্টিদাদা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেতবে আর বলছি কি! সব এক একটা ক্লাউন। মাষ্টারমশাই রাস্তা ভুল করলেন, ছোটপিসি এখনও বসে রইল...কোন মানে হয়?’
--যদি কোনদিন না আসেন?
রন্টি দাদা মন খারাপের মুখ করে বললে
তাই তো ভাবি রে বিলু... প্রথম রাস্তাটা যে মাষ্টারমশাইয়ের ফেলে যাওয়া ঠিক হয়নি, সেটা উনিও জানেন, সেটাই তো ছোটপিসির আশা রে।
--কিন্তু ধর,যদি না আসেন?
--আরে
, সবাই কি ক্লাউন নাকি? কি মুশকিল, আসবেন না মানে, আসবেন ...ঠিক আসবেন,
 তুই দেখে নিস! 
আশায় আছি
, মাষ্টারমশাই যেন আসেন,নইলে ছোটপিসি...আর ভাবতে ভাল লাগে না।


নীহার চক্রবর্তী

মন-দোল


সবুজ সেবারও মাধ্যমিকে পাস করেনি ।
অথচ দেখে বোঝার উপায় নেই । ওর বাবা-মায়ের হতাশা দেখার পর ওর সঙ্গে পথে দেখা হল ।
 
বিষণ্ণ-মনে জিজ্ঞেস করলাম,''এবার কত ছেলে পাস করল । আর তুই কিনা...''
 
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর ।
প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক হাসি ছড়িয়ে বলল, ''কি আর বলি । এবারও হল না ।''
 
আমি ওকে জানালাম,''তোর বাবা কিন্তু বলেছে আর পড়াবে না ।''
 
এবারও দেখলাম বে-পরোয়া ভাব ওর ।
 
সবুজ দূরের আকাশে উড়ন্ত ঘুড়িটা লক্ষ্য করতে করতে বলল, ''ও আচ্ছা অনেক পড়া হল ।''
 
আমি হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারলাম না ।
ঠিক পরেরদিন সবুজকে দেখলাম একটা ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটছে । 
এত গতি যে পড়েও যেতে পারে । ওর পেছনে দুটো বাচ্চা ছেলে ঢিলে প্যান্ট তুলতে তুলতে ছুটে যাচ্ছে । বেশী দূর ওকে যেতে হল না । ঘুড়িটা একটা লাইট-পোস্টের মাথায় আটকে গেল । অনেকক্ষণ মাজায় হাত দিয়ে সবুজ দাঁড়িয়ে থাকল ।
 
শুনলাম ও বাচ্চা দুটোকে বলছে,''ঝড়-বৃষ্টি না হলে আমি পেরে আনব ঘুড়িটা ।''
 
আমি আঁতকে ঊঠলাম ।
 
কাছে ডেকে বললাম,''খবরদার,এগারো হাজার ভোল্ট ।''
 
কি বুঝল কে জানে । ছোট বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ির গল্প করতে করতে চলে গেল ।
এই ঘটনার পরের দিন আমি বাবার ব্যবসায়িক কাজে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাই । মনের মধ্যে একটা ভয় ছিলই । যাবার আগে সবুজের বাবাকে সতর্ক ক'রে যাই । এমন বাউল-ছেলে আর একটি দেখিনি আমি ।
ফিরে এলাম কাজের শেষে । 
বেশ ভয় ছিল । ট্রেন থেকে সবুজের এক বাচ্চা বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সবুজ সম্বন্ধে জানতে চাইলাম ।
ও চোখ বড় বড় ক'রে বলল, ''সবুজদাদা তো বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে ।''
 
আমি অবাক হলাম শুনে । বাড়িতে না ঢুকে সবুজদের বাড়িতে আগে গেলাম ।
 
বিষণ্ণ সবুজের বাবা জানাল, ''ছেলেটা যে কোথায় গেল, খুঁজে খুঁজে হয়রান । তুমি এসে পড়েছ ভালো হয়েছে । একটু দেখো ।''
 
আমি আশ্বস্ত ক'রে ফিরে এলাম । আসার পথে দেখি সেই লাইট-পোস্টে ঘুড়িটা ন্যাতার মতো ঝুলছে ।
আমাদের গ্রামের থেকে আট মাইল দূরে শিবানন্দপুর । 
বাবার এক মহাজনের বাড়িতে যেতে হ'ল দুই-একদিন পর । সেখানে সেদিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা ছিল । একটা বড় মাঠে বহু মানুষ মিলিত হয় । সেখানেই প্রতিযোগিতাটা হয় । একটু দূর থেকে দেখলাম একটা ছেলের হাতে বেশ কিছু ঘুড়ি । ছুটে বেড়াচ্ছে একবার এদিক, একবার ওদিক । আমি এগিয়ে যেতেই অবাক হ'লাম । এ যে আমাদের সবুজ ! এখানে কী ক'রে এল ও ? আমাকে দেখে একচোট হেসে নিল ও । কিন্তু সঙ্কোচের বালাই নেই ।
আমি সবুজকে বললাম, তুই এখানে ? আর তোর বাড়ির সবাই তোর খোঁজে পাগল । তোর মাকে খুব কাঁদতে দেখে এলাম ।'' 
 ভোঁ-কাট্টা ব'লে মহানন্দে সবুজ ছুটে গেল । এ কেমন ছেলেরে বাবা ! তবে আবার কাছে এল ।
সবুজ শুরু করল, ''আরে কাকু, আমি তো এখানে এসেছি প্রতিযোগিতায় । কাল শেষ হবে । পরশু দিন বাড়ি যাব । মাকে ব'লে দিও ।''
 
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ''তোর এখানে কী লাভ,শুনি ?"
 
সবুজ অনাবিল হেসে জানাল,''প্রচুর ঘুড়ি পাব । বন্ধুদের জন্য নিয়ে যাব । কি মজা, না ব'?'
কথামতো সবুজ ফিরে এল সারাদেহ হলুদ হয়ে সেদিনই । 
শোনা গেল, গাছের মগডাল থেকে ঘুড়ি নামাতে গিয়ে সে পড়ে গিয়ে মারা যায় । গ্রাম-জুড়ে শোকের পরিবেশ । আমি সবুজের বাবা-মাকে কীভাবে আর সান্ত্বনা দিই । আমিও তখন হাপুস নয়নে কাঁদছি ।
পরেরদিন কিন্তু সেই লাইট-পোস্টে ঝোলা ঘুড়িটা আর দেখা গেল না ।


অমিতাভ দাস


স্বপ্নের সীমানা

গাড়ি আর সামনে এগুবে না । বললে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন । দেখে বোঝা গেল স্থানীয় । কারণ জিজ্ঞেস করলাম ।বললে , বরফ পড়ছে ।রাস্তা বন্ধ । সাফাই হচ্ছে । 
একথা অবিশ্যি গাড়ির ড্রাইভার সমর সিং বলেছিল । দুপুর থেকেই আকাশের মুখ ভার । তবু নতুনকে দেখবার আকাঙ্খায় বেরিয়ে পড়েছি । এখন ঘড়িতে প্রায় ছটা বাজে ।হোটেল
 ছেড়েছি বেলা তিনটের সময় ।আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের পথ । তারপর আমাদের পেলিং  পৌঁছানোর কথা ।
আমাদের সঙ্গে আছে
  আমাদের একজন ব্যাচেলর বন্ধু সুধাংশু । আরেকটি পরিবার মিস্টার দত্তের । তিনি আমাদের স্কুলের ভূগোল শিক্ষক । ভ্রমণ-পিপাসু । আমাদের বেশ সিনিয়র । তাঁর ছেলে এবার  মাধ্যমিক দিলো । সে সুধাংশুর সঙ্গে বেশ জমে গেছে ।
মিস্টার দত্তের এসব অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে । তাই বললে , মানস ঘন্টা খানেক বসে থাকো । বা একটু ঘুমিয়ে নাও । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
দেখি সুধাংশু আর সৌগত ,মানে মিস্টার দত্তের ছেলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছে সামনের দিকে ।
মৌমিতা
 আমার পাশে বসা । সে একটু ঘামছে যেন । ওর তুঁতে রঙের শাড়িটার দিকে বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছে । কী চমৎকার লাগছে ওকে !
আমাদের পেছনে আরো কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে । একদিকে গভীর পাহাড় অন্যদিকে খাঁদ ।যদিও রেলিং দেওয়া ।তবুও তাকালে পিলে চমকে যাবে ।
.
হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি ।দু'চার জন লোককে ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি । জানতে চাইছি আর কতক্ষণ লাগবে ? কেউ সঠিক কথা বলতেই পারে না । এগিয়ে তো যাচ্ছি ,বরফ কাটা হচ্ছে কোথায় ? পথ তো বেশ সাফ-সুতরা ,তাহলে ?
আমার বা-দিকে আঙুল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মৌমিতা । কিছু দূর যাবার পর দেখি একটা সাহেব মতন লোক তাঁর কুকুর টাকে
 চেন দিয়েও টেনে রাখতে পারছে না ।কুকুরটা কেমন যেন উত্তেজিত । চারপাশের লোকজন বেশ ভয় পেয়েছে । কুকুরটা ছুটে আসছে ।পেছনে  কুকুরের মালিক ।এ বাবা কুকুরটা যে আমাদের দিকেই আসছে !
মৌমিতা ভয় পেল ।সে শক্ত করে ধরে আছে আমার আঙুল । এক সময় জামা খামচে ধরলে ।ভয় পেয়েছে । কুকুরটা ছুটে আসছে । সত্যিই তো আমাদের দিকেই
  আসছে দেখছি ।মৌমিতা বললে চলো , গাড়িতে ফিরে যাই । আমার ভয় করছে ।
আমরা ফিরে আসি । দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ।
 
পাহাড়ী রাস্তা । নির্জন হয়েছে । সরু পথ । চারপাশে ঘন বন ।আমি আর মৌমিতা হেঁটে আসছি । চারিদিকে কেউ নেই ।আমি তাকিয়ে আছি মৌমিতার
 দিকে । মৌমিতাও আমার দিকে ।ওর তুঁতে  রঙের শাড়িটার ওপর কালো রঙের মোটা উলের সোয়েটার ।এই নির্জন পাহাড়ী সরু পথে চাঁদের আলোয় সে আরো সৌন্দর্যময়ী হয়ে উঠেছে । 
আমি ডান হাত দিয়ে মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরলাম । সেও আমাকে ।এতটুকু চমকাল না ।মৌমিতা আমার
 ডান হাতে এলিয়ে পড়েছে ,ওর ঠোঁটে আমার ঠোঁট ।সে যেন আবেশে চোখ বুজে ফেলেছে । চাঁদ থেকে চুঁইয়ে আসা আলো দীর্ঘ গাছগুলি ভেদ করে ওর মুখে এসে পড়েছে ।
হঠাত্ খেয়াল হল আমরা কোথায় । চারিদিকে গাছ আর গাছ । এ পথ তো চিনি না । এ তো গাছের জঙ্গল ।
 
ভয় করতে লাগল । মৌমিতা বললে ,আমরা কোথায় --কোথায় আমাদের গাড়ি ?
--আমরা পথ হারিয়েছি ।বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠল মৌমিতা ।
আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে ওপরের দিকে দৌড়তে লাগলাম ।অথচ খুব কষ্ট হচ্ছে ।পা হড়কে নীচে পড়ে যাচ্ছি । পেছন থেকে একটা হাত আমার জামার কলার টেনে ধরলে ।
.
.
ভায়া স্বপ্ন দেখছিলে নাকি ?
--কে ? কে ?
খেয়েছে
 ।আমাকে চিনতে পারছো না মানস  ? ভালোই এক চোট ঘুম লাগালে দুজনে । বললে মিস্টার দত্ত
 
এতক্ষনে বুঝলাম আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম ।দেখি পাশে মৌমিতা শক্ত করে আমার হাত ধরে ঘুমিয়ে
 আছে ।
পেছন থেকে দত্ত বৌদি বললে ,ঠাকুর পো তোমার বৌটিকে এবার ডেকে দাও ।
সত্যিই তো কী বিচ্ছিরি কান্ড ! আমরা যে পেলিং পৌঁছে গেছি । কখন যে বরফ সাফ হল আর কখন আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল জানতেও পারলাম না ।
মিস্টার দত্ত বললে , বিয়ে করলে প্রথম প্রথম
  এমনটাই হয় । চলো চলো এবার হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হতে হবে ।
.
.
সকালে ঘুম ভাঙল সুধাংশু আর মিস্টার দত্তের দরজা ধাক্কার আওয়াজে ।
 
সূর্য তখনো ওঠেনি । উঠব উঠব করছে । জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম পাহাড়ের চূড়ায়
 জমাট বেঁধে আছে মেঘ । আমরা অপেক্ষা করছি কখন মেঘের নেকাব  খুলে বেরিয়ে আসবে সূর্য ।
মিস্টার দত্তের গলায় ক্যামেরা । তাঁর ছেলের হাতেও একটি ক্যামেরা ।
 
ইতিমধ্যে তৈরী হয়ে নিয়েছে মৌমিতা । আমিও পাঁচ মিনিটে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পাঁচ তলার হোটেলের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে আকাশের রঙ । পাহাড় শিখরে কে যেন কমলা একটা মুকুট পরিয়েছে । মৌমিতার মুখে হাসি । নেচে উঠল ঁর চোখ ,ওর ঠোঁট
 
।মৌমিতার দিকে তাকিয়ে আছি । মৌমিতাও আমার দিকে ।
পাশ থেকে আড় চোখে তাকাল মিস্টার দত্ত । প্রথম প্রথম এই রকম হয় । ভায়া ,এবার একটু পাহাড়-চূড়ায় তাকাও । ওই দ্যাখো , ওইটে হল কাঞ্চনজঙ্ঘা ।
--আহা , কী উঁচু তাইনা ! অপরূপ সুন্দর ।বললে মৌমিতা ।
সারাদিন মেঘলা আকাশ । সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি । বাইরে যাওয়ার উপায় নেই । হোটেলের ম্যানেজার বললে , যে কোনো সময়ে বৃষ্টি  থেমে যেতে পারে আবার নাও থামতে পারে । 
আমাদের হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে ।আমরা স্থির করলাম আজ আর বেরুবো না ।হোটেলেই জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে । আড্ডার উপকরণ ও উপযুক্ত পরিবেশ তো তৈরী ।
 
সুধাংশু গল্পকার । ও আমাদের গল্প শোনাল । মিস্টার দত্ত প্রচুর বেড়িয়েছেন ।ফলে তাঁর মুখ থেকে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শোনা
 অন্য এক পাওয়া । মৌমিতা খোঁজ নিচ্ছিল কীভাবে সে বাবা-মাকে নিয়ে কেদার-বদ্রী যাবে ? কোন সময়ে যাবে ইত্যাদি । 
সৌগত শোনালে আবৃত্তি । বনলতা সেন ,হঠাত্ দেখা শুনতে শুনতে আমার কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল ।
 
দত্ত বৌদি একটা গান ধরলে , আমারো পরাণ যাহা চায় তুমি তাই...গলা মেলাল মৌমিতা ।
 
গাইতে গাইতে সে আমার দিকে চাইল । এইটে দৃষ্টি এড়াল না মিস্টার দত্তের ।তিনি আবার বলে উঠলেন ,প্রথম প্রথম এই রকম হয় ।
আমি থাকতে না পেরে বললাম ,
 আচ্ছা দাদা প্রথম প্রথম আর কী কী হয় ?
হাসতে হাসতে তিনি বললেন ,বলব বলব ,ধৈর্য ধরো ভায়া ।
বৃষ্টি থামছেই না । শীতটাও বেশ বেশী । এত ঠান্ডা আমার আবার পছন্দ নয় ।তবে বৃষ্টিটা চমত্কার লাগছে ।

গত রাতেই মিস্টার দত্ত জানিয়েছিলেন আজ আমদের  কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত ,গেজিং রক গার্ডেনস আর খেচুপেরিতে নিয়ে যাবেন । কথা মত সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে নটায় আমরা বেরিয়ে পড়ি ।
আকাশ আজ পরিস্কার । আমরা খেচুপেরিতে প্রবেশ পত্র নিয়ে ঢুকে পড়লাম । আহা ,কী অপার সৌন্দর্য । প্রথমেই ছোট্ট এক বৌদ্ধ মন্দির । বাইরে থেকে দেখলাম মন্ত্রখোদিত ঘূণায়মান গোলকটি । সেটা স্পর্শ করে আমরা এগিয়ে গেলাম ।
আরেকটু এগোতেই বনজ শোভায় আমরা মুগ্ধ । মৌমিতার চোখে শিশুর মত আনন্দ ঝরে পড়ছে । সে এই প্রথম পাহাড়ে এলো ।
চারিদিকে সবুজের ঘন গাছগাছালিতে ভরা । অদূরে পাথরের গায়ে কাঁচা হাতে লেখা'লাভ মাদার নেচার ।' প্রকৃতির কাছে এলে সকলেই বুঝি সুন্দর হয়ে ওঠে । সুধাংশু আর সৌগত ছবি তুলছে । দত্ত দম্পতিকেও কাছাকাছি দেখছি না । 
হাঁটতে হাঁটতে একটা লেকের কাছে আমরা । একে নাকি অনেকে ইচ্ছাপূরণ লেক বলে । অনেকের অনেক ইচ্ছা নাকি পূরণ হয় । চারপাশে কেউ নেই । থাকলেও দেখা যাচ্ছে না । আকাশে আবার মেঘ জমছে ।
আমরা একটা পাথরের ওপর বসি । কাছাকাছি কেউ নেই বলে আমি মৌমিতার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখি । মৌমিতা আরো কাছে ঘেঁষে বসে । বলে , বিয়ে করবে ?
-মানে ! চমকে উঠি ।আমি তো বিয়ে করতেই চেয়েছি এতকাল ।
 মৌমিতা চায় নি । সে সাংসারিক জটিলতায় জড়াতে চায়নি । সে লিভ ইনে বিশ্বাসী । সবাই জানে আমরা বিবাহিত ।হানিমুনে এসেছি ।আসলে তা তো নয় । বললাম , হঠাত্ বিয়ে করতে চাইছ যে...
--ইচ্ছে করছে খুব ।বলে আমার বুকে মাথা রাখল ।
.
হঠাত্ একটা কুকুরের ডাকে চমকে উঠি আমরা । ঐ তো একটা কুকুর ছুটে আসছে এদিকে । পেছনে সাহেব মতন লম্বা একটা লোক , চেন হাতে কুকুরটার পিছু পিছু দৌড়ে এদিকেই তো আসছে ।
 আকস্মিক ঘটনায় ভয় পেয়ে আমাকে  শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মৌমিতা ।