রঞ্জন যেদিন চলে গেল, নীতা সেদিন পঁচিশ। একটা দিনও এদিক ওদিক না। বাকি সারাটা জীবন নীতার এই দিনটা
কাটবে আসা-যাওয়ার টানাপোড়েনের নির্যাসটুকু নিয়ে।
নীতার শাড়ি সাদা। মুখ শুকনো, শরীর নয়। ঘরে শোনে "আহা রে! কপালটাই পোড়া!" বাইরে
শোনে "কি আর এমন বয়স!" এরকম আরো কত কি!
সাদা শাড়ি সামলে চলে নীতা। বাসে
বসে না, পাছে দাগ লেগে যায়। সাদা প্রিয় রঙ ছিল রঞ্জনের। ভালোবাসতো পরতে, সাদা জামা, পাঞ্জাবী। যেন রঞ্জনকেই সন্তর্পণে বয়ে নিয়ে চলে নীতা।
চলছিল এভাবেই। সময়ের সাথে মন, মনের সাথে স্বপ্ন, স্বপ্নের সাথে সুখদুঃখও বদলে যায়।
কাবেরী একদিন রাজী করিয়েই ফেলল
নীতাকে। জোরালো সায় দিল অফিসের বাকিরা। সায় দিল বাবা-মাও। সয়ে যাওয়া দুঃখ আর বয়ে যাওয়া জল মুছে, নীতারও বোধহয় কি যেন হয়ে গেল।
সকালের সূর্য ফ্যাকাশের বদলে লাল-কমলা
লাগলো। পাখির ডাক প্রাণে শান্তি এনে দিল। গলার কাছে ভুলে যাওয়া কিছু গান
হত্যে দিয়ে পড়ে রইল। মনের ভিতরটা হঠাৎ খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। জোরে শ্বাস
নিয়ে দেখল, হ্যাঁ, জানালাগুলো খুলে গেছে সব।
বাসের সীটে বসে লোহার জানালায়
গাল ছুঁইয়ে দিনটাকে একমনে দেখে নীতা। একটা নতুন দিন। নীতার পরনে আজ নীল। নীল রঙ
ছিল ভীষণ প্রিয় - এফ এমের গানটা মনের কথা মনে পড়িয়ে দিল। নীতার রঙ দেখে আজ ঘরে বাইরে অনেক
মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। গানটা শুনতে শুনতে
ভাবছিল নীতা, মুখগুলো
আবার রঙ ফিরে পাবে ঠিক, শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।
- ছেলে হলে পদবী রাখব ধোনি।
- আর মেয়ে হলে?
- দীক্ষিত।
- পুরো পাগল তুমি! সবাই নাম রাখে, আর তুমি রাখবে পদবী!
- ইয়েস ম্যাম! নামটা তুমি রেখো। যা খুশী। পদবী আমার থাক।
হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছিল
নীতা। যেদিন নীতা পঁচিশ।
চলন্ত বাস থেকে একটা বিজ্ঞাপনে
ধোনিকে দেখে মনে পড়ে গেল নীতার। ধোনির জামার রঙ নীল।
দরজার পিছনে যে ঘরটা থাকে তার
ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে রঞ্জন, নীতা ফিরলেই। বুকে আড়াআড়ি ভাঁজ
করা দু'হাত। চোখে এক ফোঁটা কৌতুক, অনেকখানি ভালোবাসা নিয়ে। নিজেকে
বাড়িয়ে দেয় নীতা। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলে, ভিতরের গর্ত্তগুলো বর্ষার জমা
জলে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। বয়স মোটে চার। আর নাম? মাধুরী
রঞ্জন।
অথ-বসন্ত-কথা
বসন্ত তাহার উচ্ছ্বসিত যৌবন লইয়া
গরবিনী হইয়া ঘুরিত। নাসিকা কুঞ্চিত থাকিত সর্বসময়। যাহার কারণে "অতি বড়
সুন্দরী না পায় বর" কথাটি
তাহার উপর আঁটিয়া বসিতেছিল।
পরানের বৌ শ্যামলী জ্বলিয়া যাইত
বসন্ত আশেপাশে আসিলে। লোকালয়ের মাঝবরাবর পুষ্করিণী বা মন্দিরতলার বৃদ্ধ বটের ছায়ায়, যেখানেই দেখিত, শ্যামলীর সারা দেহে সূঁচ বিঁধিত। বসন্ত যথারীতি নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া এড়াইয়া
চলিত এইসকল ক্রুর বঙ্কিম চাহনি।
তথাপি, "হইতে
পারিত" বরের দল দিগভ্রষ্ট হইয়া স্থির করিল রূপগরবিনীকে সম্যক সাজা দিবে। পরান নীরবে
যোগ দিল তাহাদের দলে। শ্যামলী বুঝি ঘূণাক্ষরেও স্বামীর অভিসন্ধির কথা টের পাইল না।
রাত্রির অন্ধকারে পাঁচিলের ওপাশে
সন্তর্পণে লাফ দিয়া পড়িল গুটিকয় মানুষ। সারি বাঁধিয়া পা টিপিয়া তাহারা অদূরবর্তী
গৃহের পানে আগাইয়া চলিল। একে অমানিশা, তায় কৃষ্ণবর্ণ পোশাকে আচ্ছাদিত।
মুখগুলি পর্যন্ত দেখা যাইতেছিল না। অকস্মাৎ, একজন বিকট
চিৎকার করিয়া লাফাইয়া উঠিল। আর একজন তাহার মুখ চাপিয়া ধরিলে, সে সেই অবস্থায় গোঙাইতে লাগিল। বাগানের সর্প তাহাকে দংশন করিয়াছে।
কাহারো এইরূপ কোনো ধারণা পূর্ব
হইতে ছিল না, তাই বুঝিতে পারিতেছিল না কি করিবে। এই ঘটনায় তাহাদের প্রতিশোধস্পৃহাও বুঝি
কিঞ্চিৎ কমিয়া আসিল।
একজন চাপা স্বরে কহিল, "জ্বালাতন!"
এই সময় গৃহের আলো জ্বলিয়া উঠিল।
বোধকরি চিৎকারেই নিদ্রা ভাঙ্গিয়া থাকিবে গৃহকর্ত্রীর। তিনি বসন্তর মা। কিন্তু
বাহিরে আসিলে দেখা গেল, বসন্ত নিজেই আসিয়াছে। খোলা কেশ
আর হস্তে তার গৃহে অধিষ্ঠিত মাকালীর খড়্গ। সে খড়্গে আঁকা চক্ষুর ন্যায় তাহার
চক্ষুও জ্বলিতেছে।
গৃহের দরজা দিয়া আলো আসিয়া
পড়িতেছিল, সর্পদংশিত মানুষটির এই মুহুর্তে ভক্তিভাব জাগিয়া উঠিল, আকুল নয়নে
হাতজোড় করিয়া কহিল,
"মা, মাগো! ক্ষমা করে দাও মা!"
অকস্মাৎ পটপরিবর্তনে, বাকিদের অবস্থাও শোচনীয় হইয়া উঠিল। কেবল পরান সুযোগ বুঝিয়া পলায়নোদ্যত হইলে, সর্পদংষ্ট্রা তাহার হাত খামচাইয়া ধরিল, বলিল, "ফেলে যেও না গো!"
পুরো দলটির মস্তকে বজ্রপাত হইল।
কেবল পরান মাথা চাপড়াইয়া বসিয়া পড়িল। ক্ষণকাল পূর্বেই মা মাগো ডাকেই সে টের
পাইয়াছিল। এই বামাকন্ঠ এই স্থানেও তাহার পিছু নিবে, তাহার
ধারণা সে স্বপনেও করে নাই।
বসন্তবালা এক্ষণে নাসিকা কুঞ্চিত
করিয়া "যত্তসব!"
বলিয়া গৃহে ফিরিয়া দরজা বন্ধ
করিল। তখন ভোর হয় হয়।