গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

শ্যামশ্রী চাকী

মুক্তি


আজ ক'মাস হলো সুজনের মায়ের কিছুদিন শুয়ে থাকাটা বেড়েছে।রাতদিন শুয়ে থাকে বিছানায়, এত আলস্যি আসে কোত্থেকে ভেবে তল পায়না সুজন!স্কুলের অন্য বন্ধুর মা'য়েরা কত এক্টিভ! সারাক্ষণ ছেলের সাথেই লেগে আছে,যদিও সুজন চোখে দেখেনি তবুও বন্ধুরাতো নিজের মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! সুজনের কপালটাই মন্দ! ছেলের কথা না ভেবে শুধু শুয়ে থাকা! এমন ক'টা মা আছে এই ভূভারতে? সুজন তো প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরে দেখে মা শুয়ে আছে। এসে এক ধাক্কা দিয়ে দুচারটে কড়া করে না বললে কাজ দেয়না... তখন উঠে খেতে দেবে জামা কাপড় গুছিয়ে দেবে জুতো জায়গায় রেখে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে ঘরে গিয়ে মরাকান্না কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমাবে।আসলে এগুলো ডাক্তার দেখানো ব্লাড টেস্ট করার ফিকির! সুজন কি বোঝেনা! বাবার টাকা খসানো ছাড়া আর কি পারে মা? মা বলতে ঘেন্না হয় আজকাল! বাবাও হয়েছে তেমন একটা কিছু চাইলেই বলবে; এই তো তোর মা এর ওষুধ কিনলাম কদিন পরে নিস!
আর কত পরে? মা যদি না থাকত কতটা খরচ বাঁচত ভাবে সুজন.... এ্যাডিডাসের জুতোজোড়ার দাম মাত্র পাঁচহাজার টাকা... এমন দু'জোড়া জুতো প্রতি মাসেই কিনতে পারতো সুজন ! সাথে জামা, ঘড়ি, সানগ্লাস আছেই, আর  দুপুরে বন্ধুদের ডেকে বাড়িতে পার্টিও অনায়াসেই করতে পারত..
যাই হোক, সুজন এসব ভেবে দিনটা খারাপ করতে চায়না, আজ স্কুল খুলেছে, পার্থ লুকিয়ে মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল স্কুলে, সেল্ফি গুলো এতক্ষণে আপোলোড করা হয়ে গেছে মনে হয়, কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে ফেসবুকে লগ ইন করে সুজন,মায়ের চিঁচিঁ আওয়াজে বলা কথাগুলো আর শুনতে পায়না.....

অফিসে বসে মিস রয়ের সাথে কথা বলছিলেন সুজনের বাবা। একটা আলাদা মাদকতা আছে মিস রয়ের চেহারাতে!আজ ডার্ক চেরী লিপস্টিকে আর স্মোকি আইলাইনারে অপরূপা মিস রয়! গলায় সহানুভূতি উপচে পড়ছে, একটা আত্মতৃপ্তি পায় সুজনের বাবা পলাশ বাবু। কিচ্ছুক্ষণ আগেই পাশের টেবিলের কল্যাণী সেন এসে খবর নিয়ে গিয়েছেন সুজনের মায়ের। এই সহানুভূতি গুলো আজকাল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন পলাশবাবু, কল্যাণী সেন সম্পর্কে অনেক গুজব বাতাসে ওড়ে,স্লিভলেস ব্লাউজ আর একরঙা শিফনে এক আলাদা গ্ল্যামার ফুটে ওঠে.... টানটান গম রঙা ত্বক! কেমন ঘোর লেগে যায়, কিছুদিন আগেও পলাশবাবুকে পাত্তাই দিতেন না কল্যাণী, তবে আজকাল সুজনের মায়ের অসুখের খবরটা জানার পর রোজ ছলছলো চোখে একবার খবর নিচ্ছেন। ক্ল্যারিক্যালে নতুন আসা শ্রাবণী আড় চোখে দেখে পলাশবাবুকে, আজও বরের লাঞ্চ প্যাক করতে দেরী হয়েছে বলে টাস টাস কথা শুনেছে শ্রাবনী... পলাশবাবু আজ ছ'মাস হল কিভাবে অসুস্থ বৌ এর সেবা করে চলছেন হাসি মুখে,এতটুকু বিরক্তি নেই, পলাশবাবুর মলিন ক্লিষ্ট  মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতর থেকে ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ওঠে শ্রাবনীর। পলাশবাবু ঠারেঠোরে দেখেন শ্রাবনীকে। মেয়েটা নতুন এসেছে, দেখতে সুশ্রী,বেশ ডবকা চেহারা, আজ ওই মায়া মায়া মত তাকানো দেখে বুঝে গিয়েছেন মেয়েটা ফাঁদে পড়েছে। একটু আগে বেড়িয়ে লিফট দেবেন কি?একটু বাজিয়ে দেখলে যদি রাজী হয় এই উইকেন্ডে টাকির রিসোর্টে বুকিং কনফার্ম করবেন, অফিসিয়াল ট্যুরের তো অভাব নেই এই অফিসে। ভাবতে ভাবতে গাড়ির চাবিটা নিয়ে পার্কিং এর দিকে এগোন পলাশবাবু।

সুমনা সব দেখতে পাচ্ছেন শুনতে পাচ্ছেন, যেটা পারছেন না সেটা স্পর্শ, গন্ধের অনুভূতি। শরীর কেমন তুলোর মত হালকা বোধ হচ্ছে সুমনার। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ফেলে আসা দেহটা ঘিরে স্বজন পরিজনদের জটলা। পলাশবাবুকে সান্তনা দিচ্ছেন পাড়ার অফিসের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সুজন ভারী গলায় মোবাইলে সব আত্মীয়দের ফোনে জানাচ্ছে খবরটা। কে একজন একগাদা সিঁদুর পরিয়ে দিলো, আলতা পরাচ্ছে সেজো'জা। এই সেজো'জা তিনদিন আগে পলাশবাবুকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল ;ঠাকুরপো! আর কত সহ্য করবে? ডাক্তারকে বলে দেখোনা একটা বিষ ইঞ্জেকশন দিয়ে যদি মুক্তি দেওয়া যায়। সে ও তো কষ্ট পাচ্ছে জ্বালা জুড়োক! আজ আলতা পরাতে পরাতে ঘন ঘন  চোখ মুছছে সেজো' জা।

সত্যিই আজ মুক্তি পেলেন পলাশবাবু,সাথে সুমনাও...একটু পরে সৎকার সমিতির গাড়ি আসবে, সুমনার গায়ে আলগোছে একটা টুকটুকে বেনারসি ফেলে দিলেন একজন শাদা শিফন আর ম্যাট লিপস্টিক পরা ভদ্রমহিলা.... আরেক জন সুদর্শনা রেডি চন্দনের বাটি নিয়ে। সামনে খোলা আলমারী, সুমনা জানে ওই আলমারিতে আছে থরে থরে সাজানো ওষুধের প্যাকেট, যেগুলো সুমনাকে কখনই ঠিক মত দেওয়া হয়নি।  আছে গাদাগুচ্ছের প্রেসক্রিপশন সেখানে যে টেস্ট গুলো লেখা আছে খুব সামান্যই করা হয়েছে। শেষ চারদিন খায়নি সুমনা কারন ওকে খাওয়ানোর কথা কারোর মনে ছিলোনা। রাতে পলাশবাবু ব্যস্ত থাকতেন ফোনে, আবেগঘন গলায় রসসিক্ত বার্তালাপ গন্ডি ছাড়াতো শালীনতার.. পাশের ঘরে নির্ঘুম চোখে সব শুনতে পেত সুমনা... শেষ দিন বিছানায় টয়লেট হয়ে গিয়েছিল, বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা হারিয়েছিল সুমনা, তীব্র কটু গন্ধ ছিল ঘরময়, আজ পারফিউম ছেটানো হয়েছে লোকজন আসাবার আগেই।  সুমনার নাকে কোন গন্ধ নেই আর,শুধু ওই রোগাভোগা দেহটার মুখে  আলতো বিদ্রুপের হাসি লেগে আছে।আর দেরী করেনা সুমনা... সুমনা আজ এক কিশোরী,  পাখা মেলেছে মেঘের দেশে, সেই এক্কা দোক্কা খেলার মাঠ, ধানগোলা, আমবাগানে সাঁঝবেলায় নামে কিশোরী সুমনা, তখন কুয়াশা মেখে জোনাকিরা সবে উড়ছে।