গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

নীহার চক্রবর্তী

বন্ধু যদি স্বজন

সমরেশের তিন বাল্যবন্ধু রঞ্জিত,সুব্রত আর অখিল  
একে-একে তিন বন্ধুই সরকারী চাকরী পেয়ে গেলো তার অনেক পরে সমরেশ চাকরীর পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে-ঘুরে শেষে তিওরখালি বাজারে ছোটো একটা মুদিখানার দোকান দিলো
তিন বন্ধুকে সমরেশ একই ভাষায় হেসে-হেসে বলল,''তোরা চাকরী পেয়েছিস আমি খুব খুশী এবার তোরা আমাকে খুশী কর আমার দোকান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ''
তিন বন্ধু এককথায় রাজী সমরেশের কথায়
ওরা তিনজন প্রায় একই ভাষায় ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে বলল,''সে আর বলতে ? আমরা আছি কী করতে,শুনি ? তুই নিয়ে ভাবিস না একদম ''
বন্ধুদের কথা শুনে আপ্লুত সমরেশ ওর বৌ ফাল্গুনীকে বন্ধুদের কথা জানালো পরে
ফাল্গুনী শুনে ফিকফিক করে হেসে বলল,''দেখো তবে তবে কী জানো ? নাহ এখন কিছু বলছি না '' 
সমরেশ অনেক চেপে ধরা সত্ত্বেও ফাল্গুনী মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বার করলো না বেশ অবাক হল তখন সমরেশ
তিন বন্ধু নিয়মিত সমরেশের দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনছে চাহিদামতো জিনিস পাচ্ছে পয়সাও মিটিয়ে দিচ্ছে ঠিক সময়
এভাবে চারমাস চলার পর একদিন সুব্রত একটু বিরক্তির সঙ্গে বলল সমরেশকে,''খাতায় ঠিক করে দাম লিখিস তো ? বৌ বলল কাল বাজারের থেকে একটু যেন বেশী...''
যারপরনাই বিস্মিত সমরেশ তখন ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো,''বেশীর কথা বলছিস তো ? হ্যাঁরে,একটু না বেশ বেশীই নিচ্ছি পরের মাস থেকে আর তোকে আমার দোকানে খেতে হবে না ''
ব্যস... সুব্রতর নাম কেটে গেলো সমরেশের খাতা থেকে
শুধু কি দোকানের খাতা থেকে ? সমরেশের বুক থেকেও বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো সমরেশ ফাল্গুনীকে কিছুই বলল না  
 সুব্রত ওর দুই বন্ধুর কাছে সব জানালো সমরেশ অবশ্য ওদের কিছুই বলেনি বলার প্রয়োজন মনে করেনি তবে কি ওর নতুন কিছুর জন্য অপেক্ষা ?
তারপর দুমাস গেলো
এক সন্ধ্যায় রঞ্জিত অফিস থেকে ফেরার পথে সমরেশের দোকানে এলো বেশ মুখ-ভার করে সমরেশের হাসি-মুখ ওর পছন্দ হল না
রঞ্জিত বলে বসলো সমরেশকে,''গত দুমাস থেকে চালটা ঠিকঠাক হচ্ছে না ডালটাও না অথচ দাম বাজারের চেয়ে কোন অংশে কম না ''
সমরেশ আগেই বুঝি ওর কপাল-লিখন পড়ে ফেলেছিল
তাই তখন এক চিলতে হেসে বলল রঞ্জিতকে,''এই হয় সুব্রতরও তাই হয়েছিলো মাসের পয়সা মিটিয়ে এবার বিদেয় রে আমি আর পারছি না ''
বলতে বলতে সমরেশের গলা ধরে আসে কান্নায় কিন্তু সে বোঝার ক্ষমতা ছিল না রঞ্জিতের পয়সা মিটিয়ে হনহন করতে করতে বেরিয়ে গেলো নিমেষেই সমরেশ কিন্তু সে কথাও ফাল্গুনীকে বলেনি পরে  
ফাল্গুনী বন্ধুদের কথা জানতে চাইলে সমরেশ বারংবার বলে ওকে,''সব ঠিক আছে চলছে বেশ ''
কিন্তু ফাল্গুনীর মুখের অবিশ্বাসের হাসি ওকে অবাক করে খুব
রইলো বাকি এক  
অখিল সমরেশ ভাবল, আর যেতে কতক্ষণ ? কানে কি আর বিষ ছড়ায়নি ? বেশ ছড়িয়েছে
কিন্তু একদিন অখিল নিজেই সখেদে বলল সমরেশকে,''সব কানে এসেছে আমার আমি মোটেও বিশ্বাস করিনি আমার কোন অভিযোগ নেই তোর জিনিসের ব্যাপারে আর একটা কথা অভিযোগের কী আছে ? আমরা যখন বাল্যবন্ধু,তখন শলা-পরামর্শ করে একে-ওকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাই না ?''
অখিলের কথা শুনে সমরেশের দু'চোখ ছলছল করে উঠলো তখন তা লক্ষ্য করে অখিল শীতের সন্ধ্যায় দোকানের বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো সমরেরশের দিকে হৃদয়ের উষ্ণতা বোঝাতে সমরেশ ওর হাত চেপে ধরে খুব ঝাঁকাতে থাকলো নিজের দুঃখগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায়
সেদিন রাতেই সমরেশ ফাল্গুনীকে সব বলল একে-একে
ফাল্গুনী সব শুনে গালে হাত রেখে মৃদু-হেসে বলতে থাকলো,''হুম তবে তোমাকে একটু বলার আছে আমার তুমি এখন ব্যবসায়ী তোমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক অর্থের তোমার খদ্দেরদেরও তাই তোমার আগের দুই বন্ধুকে আমি ভুল বলছি না আর যে আছে,সেও তোমার ভরসা নয় এভাবেই চল বুঝলে আমার কথা কি ?''
সমরেশ তখন অম্লান-হেসে উত্তর দিলো,''বুঝলাম গো সব বুঝলাম কিন্তু বন্ধুত্ব এমন এক ব্যাপার বুকে খুব খচখচ করে ওঠে তাই ভুলতে একটু দেরী হবে তারপর একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো তুমি ''
পর মুহূর্তেই ফাল্গুনী সমরেশের মাথাটা ওর কোমল বুকে টেনে নিলো এবার কিন্তু ফাল্গুনী চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না সমরেশ ওর বুক-জুড়ে কেঁদে চলল শিশুর মতো বাইরের রাতের অন্ধকারও বুঝি তা দেখেছিলো তাই সেই কখন যাওয়া বিদ্যুৎ হঠাৎ চলে এসে ঘর আর বাইরের পরিবেশকে আলোকিত করে তুলল বুঝি যন্ত্র-হৃদয়ের উষ্ণতার নামান্তর ? কিছু মানুষের কেন যে কম !