গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ১০ম সংখ্যা ।। ২১শে মার্চ ২০১৭

এই সংখ্যার লেখকসূচি - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুবীর কুমার রায়, মুস্তাইন সুজাত,  পার্থ রায়, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, অলভ্য ঘোষ, মনোজিৎ কুমার দাস, তাপসকিরণ রায়, দেবাশিস কোনার ও শুক্লা মালাকার ।  

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

এই প্রবাস

(১) 

লাহা বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই  হল্লাটা কানে এলো মালিনীর। আর কয়েক পা এগোলেই ‘স্নেহ কুটির’কে বাঁয়ে রেখে ডান দিকে ঘুরে গেছে রাস্তাটা। পাঁচ-ছটা বাড়ির পরেই একটা তেমাথা মোড়, মোড়ের মাথায় সীতারামের দোকান, সীতারাম নট্ট কোম্পানী। নামেই নট্ট কোম্পানী, এখন শুধু থিয়েটারের ড্রেস ভাড়া পাওয়া যায় আর সন্ধ্যেবেলা দোকানে ছেলে ছোকরাদের আড্ডা বসে। জোর আড্ডা বসে বিশেষ বিশেষ সময়ে। যেমন দোলের আগে, পুজোর সময়, দেওয়ালি আর পিকনিকের আগে। সীতারামের দোকানটা পেরিয়েই বাঁদিকে বাঁকের মুখে মালিনীর বাড়ি। সীতারামের দোকানের পাশে এই পাড়ার সবচেয়ে ধনী পরিবারের বাড়ি ‘রাধাকুঞ্জ’,  ওদিক  থেকেই হল্লাটা আসছে মনে হল। এখানকার বাড়িগুলোর সব এমনিই নাম। ‘ইন্দু-কিরণ’,’বনলতা’, স্নেহকুটির’ এমনি সব আরও কত কি। অবাঙ্গালী পরিবেশে যতটা বাঙ্গালীয়ানা বজায় রাখা যায় আর কি! পূর্বপুরুষেরা কবে জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছিলেন, মিলমিশ হয়ে অনেক কিছুতেই শুধু বাড়িগুলোর নামেই রয়ে গেছে বাঙ্গালীয়ানা। ‘রাধাকুঞ্জর’ সামনে আসতেই জোর হল্লার আওয়াজ কানে এলো। মালিনী বুঝল, আজ খুব জোর দুর্গাপুজোর মিটিং শুরু হয়েছে, কাল ভোরে মহালয়া।
প্রভাদির বাড়ি থেকে ফিরছিল মালিনী। পরশু স্কুলে একটা মিটিং আছে। প্রভাদি এখানকার মেয়ে ইস্কুলের হেড দিদিমনি। বছরখানেক হল মালিনী ঐ স্কুলে দিদিমনি হয়ে ঢুকেছে। আগামীকাল  বাড়িতে একটু পুজোপাঠের ব্যাপার আছে, হয়ত সময় করে উঠতে পারবে না, তাই আজ বিকেলেই ঘুরে এল। ফিরতে দেরী হয়ে গেল। খুব যে দেরি ঠিক তাও নয়। কিন্তু বিহার-বাংলার  এই মফস্বলী  জায়গায় তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসে।এখনও পুজো শেষ হলনা, এর মধ্যেই  সন্ধ্যে ছটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার। আজ আবার আকাশ একটু মেঘলা হয়ে আছে।  আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে চাইল মালিনী, তারপর পা চালিয়ে রাস্তাটুকু পার হয়ে মোড়ের মাথায় এসে পড়ল।
দূর থেকেই বুঝতে পারল সীতারামের দোকানের এক চিলতে বারান্দায় আজ তিল ধারণের জায়গা নেই। কে নেই ওখানে? বাপি,ঋষি,তনু, লাল্টু,বাদল, দুলু, বাটু,সীতেশ,হীরালাল এমনকি টুটুল মানে ইব্রাহিম পর্য্যন্ত! সীতারামের দোকানের আগে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা।  কা’দের যেন বাড়ি করার কথা ছিল, শেষমেশ আর হয়ে ওঠেনি। একটা প্রকান্ড বড় শিউলি গাছ আছে,অজস্র ফুল ফুটে আছে। শিউলির গন্ধে সারা রাস্তাটা ম’ম করছে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গন্ধটা নাকে এসে লাগল মালিনীর। তার ভাল লাগছিল। বাঁদিকের বাঁকের মুখে এবার এসে পড়ল মালিনী। বাঁদিকের প্রথম বাড়িটাই মালিনীদের। মালিনীর বাবা ছিলেন এ তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার, আজ দুবছর হল মারা গেছেন। দাদা মারা যাওয়াও হয়ে গেল প্রায় সাত/আট বছর।  দাদা মারা গিয়েছিল মহালয়ার দিন। আগামীকাল তার মৃত্যুবার্ষিকী।
ফাঁকা জায়গায় শিউলি ফুলের গন্ধের জন্যই হোক কিংবা দাদার কথা ভাবার জন্যই হোক অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল মালিনী। ডানদিকে তাকাতেই দেখল সাইকেলে হেলান দিয়ে শুভ দাঁড়িয়ে আছে। সেও সীতারামের দোকানের দিকেই যাচ্ছে, মালিনীকে দেখে দাঁড়িয়েছে। মালিনী কাছাকাছি আসতেই জিজ্ঞাসু মুখে তাকাল।
খুব মৃদুস্বরে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছে এভাবে মালিনী জিজ্ঞেস করল—কখন?
-বিকেলেই...তুমি এখন?
-প্রভাদির বাড়ি গিয়েছিলাম,একটু দরকার ছিল, আমি চলি...’ তাড়াতাড়ি পা চালাল মালিনী। সীতারামের দোকানের দিকে একবার মুখ তুলে চাইল, দেখল সবাইকে। মালিনীকে দেখতে পেয়ে বাটু আর টুটুল ছুটে এল—এবার কিন্তু তোমার আলাদা চাঁদা, মিলিদি।‘
--কেন?
--বারে, চাকরি করছ না!
--বেশ, তাহলে বিজয়াটা বাদ দিস্‌!
--ইস্‌...বাদ দিলেই হল! না বোলনা কিন্তু মিলিদি, এটা আমাদের প্রেস্টিজ...প্লিজ!’
--আচ্ছা যা, দেব’ বাঁ দিকে ঘুরে গেল সে। বাড়ির ফটকে হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল,   আলোদি দাঁড়িয়ে, হাতে একটা কাগজ।


‘এত দেরী হল তোমার, আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি দিদি’...কাতর গলা শোনা গেল আলোর। আলো এবাড়ির আয়া, নার্স, রাঁধুনী, পাহাদারনি এককথায় সব। দাদা আর বাবার  মৃত্যু মা’কে একেবারে শয্যাশায়ী করে রেখেছে প্রায় এক বছর হতে চলল। সারাদিন স্কুলে থাকে মালিনী, আলো তার ডান হাত। বাড়ির সব কাজে তো বটেই!
-কেন , কি হয়েছে আলোদি’—ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মালিনী।
--তোমাকে বলতে ভুলে গেছি দিদি, মায়ের রাত্রে খাবার আগের ওষুধ টা শেষ হয়ে গেছে। রাগ কোর না দিদি, তুমি বাইরে বেরোবার আগে বলতে এসে দেখি, তুমি বেরিয়ে গেছ।  সকালে যদি বলে রাখতাম... ইস্‌’ আপশোষের স্বর আলোর।
--দেখি, কাগজটা দাও। টাকা এনেছ?
-হ্যাঁ, এই যে নাও। দোকানে ছেলেদের কাউকে বল না দিদি,ওরা কেউ ঠিক এনে দেবে।‘
--দেখি...’ আবার পা বাড়ায় মালিনী। ফটক খুলে বাইরে এসে দোকানের কাছাকাছি দাঁড়ায় কিন্তু ঠিক কাকে ডাকবে বুঝতে পারছিল না। ওরা নিজেদের মধ্যে এতো হই-হল্লার মধ্যে রয়েছে, ওদের ডাকতেই খারাপ লাগছিল মালিনীর। নিজেই ওষুধের দোকানে চলে যাবে কিনা ভাবছিল, হঠাৎ ঋষি এদিকে তাকিয়ে তনুকে কানে কানে কিছু যেন বলতেই তনু চীৎকার করে উঠল--   কি রে, কি হয়েছে, কিছু বলবি?’
তনুই ডেকে বলল টুটূলকে, ‘এই দেখ তো কি হয়েছে, মিলি কিছু বলছে যেন!’
ছু্টে এল টুটুল। মিলি কুন্ঠিত স্বরে টুটুলের হাতে কাগজটা দিয়ে বলল—আমার একটা কাজ করে দিবি রে?’
--অমন করছ কেন, কি করতে হবে, বলো না?
-তোরা এতো নানা কাজে ব্যস্ত আছিস, আর আমি মাঝ থেকে তোদের...’ কুন্ঠিতভাবে কাজটুকু জানাল মালিনী।
--ছাড়ো তো, দাও আমাকে। তুমি ভিতরে যাও,আমি দিয়ে আসব’ বলল টুটুল।
দোকানের কাছে আসতেই শুভ জিজ্ঞেস করল- কি হয়েছে রে, সিরিয়াস কিছু?’
--কি জানি, ঠিক বুঝলাম না, একটা ওষুধ আনতে দিল। দুলুকে ইশারা করল টুটুল—তোর সাইকেলটা নিয়ে গেলাম।
-কালকেই তো মহালয়া, নারে?’ শুভকে জিজ্ঞাসা করল ঋষি। জবাবে মাথা নাড়ল শুভ।
--এবার থেকে আমাদের এই মিটিং টা অন্য জায়গায় করতে হবে,বুঝলি? কেন যে মনে থাকে না!’ মৃদুস্বরে বলল ঋষি। প্রতিবারই ওদের মনে হয় কথাটা, কিন্তু কেন জানা নেই হয়ে ওঠে না। তারুণ্যের কি এটাই স্বভাব! অথচ, রণেনের মৃত্যু তো ওদের মনে না থাকার কথা নয়। মালিনীদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে শুভ।
টুটুল মালিনীদের বাড়ির বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছে মালিনীর সঙ্গে। হাতের প্যাকেট মত কিছু একটা টুটুলের হাত থেকে আলো নিয়ে দুজনে ভিতরে গেল। টুটুল ফিরে আসছে। এসে দেখল বাপিদার হাতে অনেকগুলো চায়ের ভাঁড় আর দুলু সকলকে চা ঢেলে দিচ্ছে।  দুলুর কাছ থেকে চা চেয়ে নিয়ে গরম চায়ে একটা চুমুক দিল টুটুল। 

(পরের অংশ আগাম সংখ্যায় )


মুস্তাইন সুজাত

বর্ধিত বেতন


এক

অফিসে বুক সমান কিউবিকলে থুঁতনি ঠেকিয়ে জাকির বলে,
-একটা কথা শুনসেন নি স্যার?
-কি কথা জাকির?
-এরিয়ারের টেকাটা দিব না।
-তা তো জানাইছিল। এ আর নতুন কি?
-আগে বলসিল না স্যার, বেতন বাড়িয়ে গত ২ বছরের এরিয়ারের টেকাটা দিব?
-হুম, তা বলসিল।
-এখন দিব না।
নিজেরও তো পাবার কথা। জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি কি কনফার্ম জাকির?
-জি স্যার। সিউর।
অফিরের তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরীজীবীদের এরকম টাকা-পয়সা সম্পর্কিত তথ্য আমি বিশ্বাস করি। ওদের ইনফরমেশনগুলোঅধিকাংশ অথেনটিক হয়।
কিউবিকলে চেয়ারে বসে আছি। এখনক্লাস নিতেযাব। স্টুডেন্টরা আসছে একে একে।

দুই
ক্লাস থেকে ফিরে চেয়ারে বসতেই জাকির এগিয়ে আসে।
-স্যার, একটা কথা ছিল।
-বলকি কথা?
-ভাবসিলাম স্যার ঐ টেকাটা পাইলে মেয়ের নামে ডিপোজিট করব। এইটা আর হইল না।

কথাটা শুনে চমকে উঠি। কত আর মাইনে তার? ৭/৮ কিংবা ১০ হাজার সর্বোচ্চ? কতই বা আর বাড়তে পারে মাইনে? ১ কিংবা ২ হাজার বড়জোর? প্রতি মাসে বর্ধিত এই ক্ষুদ্র টাকাগুলো একত্রেজড়ো করে সেতার মেয়ের ভবিষ্যৎরক্ষা করার একটা প্রয়াস চালাতে চাইছে। তার মেয়ের জন্য কিছু আগাম নিশ্চয়তা খুঁজতে চাইছে। অথচ তার প্রাপ্যটা সে পাচ্ছে না। ভাবছি, আমিও কি পাচ্ছি প্রাপ্য?
মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। কিছু বলা যাবে না, কে কখন ক্লিকবাজি করে। চাকরিটাই খোয়া যাবে শেষে। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই দীর্ঘশ্বাসের অধিকারটুকুই কেবল আমার নিজস্ব কথা। কেউ বুঝবে না এর অর্থবহতা।

চতুর্থ শ্রেণীরকর্মচারী জাকির সদ্য মেয়ের বাবা হয়েছে। তার মেয়ের বয়স তেইশ দিন।




পিঙ্ক তোয়ালে এবং একজন লুজার
-শরীরে একটাও স্পট নাই। উফ চামড়ার কি কালার মাইরি!
-দেখলেন ক্যামনে?
-দুই প্যাগে কি আর এতো কিছু বলা যায়?
মুচকি হাসে কথক। যেন বলার বাহানায় সে অতিরিক্ত এক প্যাগ চায়।
-কইয়া ফালান।
নতুন প্যাগ এগিয়ে দিতে দিতে শ্রোতা বলে। 
-হয় কইয়াই ফালাই।
-কন না ক্যান?
-হয় কইয়াই ফালাইতাইলে, আরকি? 
-বুজসি, পিক-টিক আছে নিচ্ছই?
-হয়। ৩ টা পরপর পাঠাইছিল। আহা! গোসলের পর পিঙ্ক তোয়ালে জড়ানো শরীর-বুক থেকে ঊরু অবধি আর মাথায় হালকা আকাশি। ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে। উফ!  
-ভাই, দেখান না। প্লিজ!প্লিজ ভাই দেখান না!
-দেখানো ঠিক হইব না। বইনে আমারে বিশ্বাস করে।
-হে হে হে। কারে? আপনেরেনি?
-হয়।
-বালডা চিনে আপনেরে?  
-শুরুর দিকে একদিন কইসিলাম, আমারে যে পিক পাঠাও, লিক হইতেও তো পারে। তখন?
-কি উত্তর দিসিল মালে?
-কইসিল, আপনারে আমার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি।
-হে হে হে। যদি জানতো বইনে-শালা আপনি সেইরকম একটা অবিশ্বাসী, অয় আর কোনদিন নিজেরেই বিশ্বাস করতে পারতো না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া ফেলতো কসম।
প্যাগের পর প্যাগ চলে আর রাত বাড়ে মাতালদের ঘাড়ে চড়ে।

পিঙ্ক তোয়ালে গায়ে জড়ানো ছবিটা কল্পনায় নেয় আশিকুর রাহমান। আশিকুর সুদর্শন যুবক, দীর্ঘ শরীর। ফর্সা মতন দেখতে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। বাট লুজার হিসেবে হা হুতাশ করে সে নিয়মিত। হ্যাঁ, আশিকুর ওর দৃষ্টিতে লুজারই বটে। অন্য সবদিক ঠিক থাকলেও-প্রেমের ক্ষেত্রে সে লুজার। বিলক্ষণ কু-ভাগ্য তার। স্কুল জীবন থেকে অনেককেই পছন্দ করেছে তবে বলতে পারেনি কোনদিন। কিংবা বলেতে যাবে, দেখে অন্যের সাথে ততদিনে জুড়ে গেছে সেই মেয়ে। কলেজে উঠে যাকে পছন্দ করেছিল, অপেক্ষায় অপেক্ষায় একখানা চিঠি লিখে যেদিন দেখা করতে রওয়ানা হল সাত মেইল দুরের গ্রামে, গিয়ে শুনে বিয়ে হয়ে গেছে মেয়েটার। বাড়িতে ফিরে আগুনে পুড়ায় চিঠি। এরপর ভার্সিটিও সিদ্দিকুরকে তেমনি প্রেমিকাশুন্য করে রাখলো। চাকুরীতে ঢুকে তো আরও বেখাপ্পা অবস্থা! আশিকুর লুজার । গল্প শুনে আর একটু পরপর আশিকুর বলে উঠে,

-আই এম এ লুজার।

সুবীর কুমার রায়।

   উপহার

তপনের বিয়েতে গিয়ে সেদিন রতনের সাথে দেখা। তপন যে তার অনেক দিনের পরিচিত জানা ছিল, কিন্তু সে যে নিমন্ত্রিত জানা ছিল না। সেও বউ নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছে। দামি বেনারসি শাড়ি, গলায় হাতে ঝলমলে জড়োয়ায় অপর্নাকে খুব সুন্দর লাগছে। রতন আমার বাড়ির কাছেই থাকে। তিনতলা মার্বেল মোড়া বাড়িতে সে আর অপর্না, না ভুল বললাম, অনেক ডাক্তার, অনেক জ্যোতিষী, মাদুলি তাবিজ করে বিয়ের পনেরো বছর পরে, মাস চারেক আগে তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। এতকিছু আমার জানার কথা নয়, কিন্তু ওদের ও আমাদের, উভয়ের বাড়িতেই শুক্লা কাজ করে। আর মেয়েদের এরকম একটা বার্তাবাহিকা শুক্লা পেলে হাঁড়ির খবর জানবার আগ্রহ শতগুণ বেড়ে যায়।
আমার স্ত্রীর হাতে একটা কাপড়ের প্যাকেট, অপর্নার হাতে রঙিন কাগজে মোড়া কিছু একটা উপহার। অপর্না তার মা’র কাছে বাচ্চাটাকে রেখে এখানে এসেছে, তাই আর দেরি না করে নতুন বউকে উপহার দিয়ে খেতে যাবে। আমার স্ত্রীও ওর সাথে উপহার দিতে যাবে, এমন সময় রতন জিজ্ঞাসা করলো আমরা কি উপহার দিচ্ছি। আমার স্ত্রী জানালো শাড়ি। সাথে সাথে দ্বিতীয় প্রশ্ন, কত দাম নিলো? তপনের সাথে সম্পর্কটা আমাদের খুব ভালো, তাই একটু দাম দিয়েই একটা শাড়ি কেনা হয়েছে। শাড়ির দাম শুনে রতন বললো, “তপনের অবস্থা তো খুবই ভালো, তাছাড়া তোরা দু’জনে আর কতো খাবি যে এতো দামি শাড়ি দিচ্ছিস? আমরাতো একটা বই দিচ্ছি, আমি আর কতো খাবো, অপর্নার কোলে ছোট বাচ্চা, ও তো অর্ধেক আইটেম ছোঁবেই না। অবশ্য বইয়েরও যা দাম হয়েছে, অনামী লেখকের পাতলা একটা বইয়ের দামও ভালোই পড়ে গেল”।
নতুন বউয়ের সাথে আলাপ করে, উপহার দিয়ে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরে এলাম। রতন যথেষ্টই খেলো, তবে বাচ্চা এখনও বুকের দুধ খায় বলে অপর্না কিছু কম খেলো।
মাস দুয়েক পরে রতন এসে বহু কষ্টার্জিত পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন করে গেল। কয়েকদিন পরে বাড়ির কাজের মেয়ে শুক্লা হঠাৎ বেশ কিছু টাকা ধার চাইলো। মেয়েটা খুব ভালো, তাছাড়া আজ পর্যন্ত কোনদিন সে একটা পয়সাও ধার চায় নি। তাই কোন কথা না বলে তাকে টাকাটা দিয়েই দিলাম। সে মাসে মাসে কিছু কিছু করে শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খুশি হয়ে চলে গেল।
অন্নপ্রাশনের দিন তিনেক আগে শুক্লা কাজ করতে এসে একটা ছোট রূপোর থালা, বাটি, ও চামচ দেখিয়ে বললো যে সে রতনের ছেলের জন্য কিনেছে। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “তুই গরিব মানুষ এতো টাকা খরচ করতে গেলি কেন”? সে একটু চুপ করে থেকে বললো “বাচ্চাটাকে জন্মাতে দেখেছি, চোখের ওপর বড় হলো। আমি এতো টাকা কোথায় পাবো বলো? তোমাদের মতো আর সব বাড়ি থেকে কিছু কিছু ধার নিয়ে কিনে ফেললাম। ও তুমি ভেবো না, কয়েক মাস একটু কষ্ট হবে, আমি ঠিক ধার শোধ করে দেব”।




মনোজিৎকুমার দাস

  
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু                                                                                                                              
:ভোর হচ্ছে বুঝতে পেরে সুনন্দার মনে একটু একটু  স্বস্তি ফিরে আসছে । সে রাতভোর এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে কাটিয়েছে  তার এক কালের শ্বশুর বাড়িতে।। অফিস ছুটি হলে সুনন্দা বনগাঁও লোকাল ধরে সন্ধে সন্ধ্যে বাড়িতে পৌঁছে থাকে।  মধ্যমগ্রামে বদলি হয়ে আসার পর থেকে সুনন্দা এটাই করে আসছে । ,কিন্তু ওদিন রমেশদার দোকানের কাছে আসতেই শ্রাবণের বৃষ্টি শুরু । অগত্যা রমেশদার দোকানে আশ্রয় নেয়া ।বনগাঁও লোকাল ধরতে হলে বৃষ্টির মাঝে দৌড়েও ট্রেন ধরা যাবে না , প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে দু’একটা রিক্সা চলাচল করলেও শত চেষ্টা করেও একটা রিক্সাকেও সুনন্দা দাঁড় করাতে ব্যার্থ্ হলে রমেশ নিজেও রিক্সা থামাতে পারল ।  
“ ট্রেনের অভাব নেই , বৃষ্টি ধরলে আমি না হয় ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব ,দিদি । " দাদার সঙ্গে বৌদির ডিভোর্স হবার পর রমেশ সুনন্দা বৌদিকে দিদি বলে ডাকে । সে ভেবে পায় না এমন মেয়ের সঙ্গে দাদার বনিবনা হল না । বৃষ্টি থামার নাম নেই দেখে পার্সের ভেতর থেকে ফোনটা বের করে মাকে জানায় সুনন্দা , " বৃষ্টিতে আটকে রমেশদার দোকানে বসে আছি ।এদিকের যা অবস্থা একলা আমি শেষ ট্রেন ধরব ? "
 "রমেশে তো বউ বাচ্চা নিয়ে ওখানেই থাকে । তোর বিয়ের পর পরেশ তাদের মধ্যমগ্রামের বাড়িতে থাকতো। তুই রাতটা রমেশের ওখানে থাক । বিপদে নিয়ম নাস্তি ।  রমেশের বউ তোকে ভাল জানে " মায়ের কথা শুনে সুনন্দা ভাবে , ওখানে থেকে যাওয়া কি ঠিক হবে ?  কাল রবিবার, ভোরের ট্রেন ধরে সে বাড়ি ফিরবে ।  ওই বাড়িকে ঘিরে তার বিবাহিত জীবনের কত স্মৃতি যে জড়িয়ে তা আছে-------। সুনন্দা আর ভাবতে পারে না।  
বৃষ্টি থামলে রমেশ দোকান বন্ধ করার আগে সুনন্দাকে বলে ,"আমাদের ওখানে চল দিদি ।"  অগত্যা সে এক সময়ের দেওর রমেশের সঙ্গে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে কিনা ভাবতে থাকে।সুনন্দা ইতস্তত ভাব দেখালে রমেশ বলল , "দিদি তুমি ভেব না । দাদা  সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার কোন আশংকা নেই। " রমেশ ভাবল , দাদা বাড়িতে নেই অনেকদিন, কোথায় বর্তমানে আছে তা কেউ বলতে পারে না।   
বাবার কাছেই সুনন্দার গান শিক্ষার হাতেখড়ি। মধ্যমগ্রামে থাকাকালে সুনন্দার বাবা সুভেন্দু দাস অবসর সময়ে গান বাজনা নিয়েই থাকতো। সে সময় সুভেন্দু দাস মধ্যমগ্রাম পৌরসভার সচিব পদে কাজ করতেন। সুনন্দার জন্ম মধ্যগ্রামের বাসায়। গোবরডাঙ্গার পৈত্রিক বাড়িতে সুনন্দার কাকারা থাকেন। পরেশের বাড়ি মধ্যগ্রামে হলেও পরেশরা এক সময় তার বাবার চাকরীর সূত্রে কলকাতার কালীঘাটে থাকত। সুন্দদা ও পরেশের বিয়ে কিন্তু হয়েছিল মধ্যমগ্রামের বাড়িতে, কারণ , তখন পরেশের বাবা অবসর নেওয়ায় তিনি দেখলে বাসা ভাড়া নিয়ে কলকাতায় থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই। পরেশেরে সঙ্গে সুনন্দার সেটেল্ড ম্যারেজ বললেও আসলে তাদের বিবাহিত পূর্ব্ জীবনে তারা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিল প্রগাঢ় ভাবেই। সুনন্দা সুন্দরী, ভাল গান গায় এবং অভিনয়েও পারদর্শী। অন্যদিকে, পরেশের চেহারাও সুন্দর, কথাবার্তায় চৌকোষ ।স্টার থিয়েটারে সুনন্দার পরিচয় হয় পরেশের সঙ্গে। এক সময় সুনন্দা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও এক সময় পরেশের জন্যেই সে নায়িকা হওয়ার সুযোগ পায়। রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গীতিনাট্যে পরেশ ও সুনন্দা মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার পর পরেশের সঙ্গে সুনন্দার চেনাশোনা প্রগাঢ় হতে থাকে। অভিনয়ে দু’জনের নামডাক হওয়ার আগেই পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরেশের সঙ্গে সুনন্দার বিয়ে হলে সবচেয়ে খুশি হয় সুনন্দা।
সুনন্দার সাত বছরের বিবাহিত জীবন সুখের ছিল।তারা দু’জনে এক সঙ্গে মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতার খিয়েটার পাড়ায় যাতায়াত করতো। বেশ কয়েকবার তারা লোকনৃত্য অংশ গ্রহণ করতে মুর্শিদাবাদ এবং ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরে গিয়েছিল। তারা এক সঙ্গে লোকনৃত্যে নেচেগেয়ে আসর মাতিয়ে তুললেও কিন্তু সুনন্দা কখনোই থিয়েটারের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারেনি পরেশকে। তবে পরেশকে সুনন্দার ভাল লাগতো। সে কোনদিনই কল্পা করেনি একদিন সে পরেশের বউ হবে। কিন্তু সেটাই হল একদিন। তখনো সুনন্দার মা বেঁচে , তবে সে কয়েক মাস অসুস্থ হয়ে শয্যশায়ী। সুনন্দার মা তার বাবাকে বলল,“ মরার আগে সুনন্দার বিয়েটা দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম। পরেশ ছেলেটা তো এক সঙ্গে কলকাতায় অভিনয় করে। ওই ছেলেটা সঙ্গে আমার সুনন্দা মায়ের বিয়ে হলে কেমন হয় সুনন্দদার বাবা।” সুনন্দার মায়ের কথাটা তার মনে ধরে।
সুনন্দাকে পরেশের ভাল লাগলেও সুপ্রিয়া নামের একটা মেয়ের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা এখনও আছে। মেয়েটি তার স্কুল বান্ধবী থেকে একদিন প্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠে। পরেশের চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়তো সুপ্রিয়া। পরেশ ও সুনন্দা স্কুলের পাঠ শেষ করে এক কলেজে ভর্তি হয়। বার ক্লাস শেষ করার আগেই পরেশ ও সুনন্দার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক্ গাঢ় হল। তারা ঠিক করল কলকাতার নাম করা কলেজে একই বিষয়ে পড়বে বলে তার ঠিক করে। কিন্তু তাদের আশা ব্যর্থ্ হয়ে যায় হঠাৎ করে সুপ্রিয়ার বাবা সুকোমলবাবু বোম্বাইতে বদলি হয়ে যাওয়ায়। সুপ্রিয়া কলকাতা থেকে চলে গিয়ে বোম্বাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এ ভর্তি হলে পরেশ এক এক বার ভাবে, “ আগে সিদ্ধান্ত নিলে সেও বোম্বে চলে যেতে পারতো। পরেশের মা জানতো্ পরেশ সুপ্রিয়াকে ভালবাসে। কথাটা পরেশই তার মাকে বলেছিল। এর বেশি বলবার সাহস করেনি পরেশ। পরেশরা গোবরডাঙ্গার আদি বাসিন্দা। আসলে তারা ঘটি, অন্যদিকে পরেশরা পূববাংলা থেকে আসা রিফিউজী।  পরেশের মায়ের সন্দেহ ছিল সুপ্রিয়া তাদের পাল্টি ঘর কিনা।
বোম্বে যাওয়ার পর পরেশের সঙ্গে সুপ্রিয়ার ঘনিষ্টতা আর থাকার কথা নয় এটা ভেবে পরেশের মা স্বস্তিবোধ করলেও কিন্তু পরেশ।সুপ্রিয়ার কথা ভুলতে পারে না।সে স্ব শরীরে বোম্বে যাওয়ার কথা ভাবে। টেলিফোনে সে সুপ্রিয়ার যোগাযোগ করে, কিন্তু সুপ্রিয়া আগের মতো তার সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহী নয় পরেশ বুঝতে পারে। কয়েকদিন পরে রাত বারটা দিকে সুপ্রিয়া টেলিফোনে পরেশকে যা বলে, “ তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও।, আমার বিয়ের কথা চলছে বোম্বে প্রবাসী কলকাতার এক বনেদী ঘরের ছেলের সঙ্গে। ছেলে একটা বড়সড় মাল্টিন্যশনাল আইটি এন্ট্রারপ্রাইজের এক্সিকিউটিভ।” জবাবে পরেশ কী বলবে ভেবেই পায় না!।
সুনন্দা নামের মেয়েটিকে পরেশের মার ভাল লাগে। একবার কলকাতায় গিয়ে পরেশের মা রবীন্দ্রসদনে পরেশ ও সুনন্দার অভিনয় দেখে পরেশের মনে আশা জাগে সুনন্দার সঙ্গে পরেশের বিয়ে হলে ভালই হবে।।
পরেশের সঙ্গে পরামর্শ্ না করেই এক সময় পারিবারিক ভাবে সুনন্দার সঙ্গে পরেশের বিয়ের প্রস্তাব দেয় পরেশের বাবা মা। পরেশ এ খবরটা জেনে প্রথমে সুনন্দাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে। সে বলে,“ যার সঙ্গে নাটকে বরবধূর অভিনয় করি তাকে আমি বিয়ে করতে পারি না। পরেশ তখনও সুপ্রিয়ার  সেদিনের কথা সুনন্দার মনে পড়ে।
তারপর থেকে পরেশের মধ্যে বাউণ্ডেলাপনা দেখা যায়।। পরেশের বাবা ও মা সুনন্দার সঙ্গে পরেশের সঙ্গে বিয়ে দেওয়র জন্য উঠে পড়ে লাগে ।সুনন্দার বাবা মা পরেশের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়।।বেশ জাকজমকের করে পরেশের সঙ্গে সুনন্দার বিয়ে হয়। পরেশ সুনন্দার সঙ্গে নাটকরা বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন যেতেই সুনন্দা বুঝতে পারে তার স্বামী পরেশ সুপ্রিয়াকে ভুলতে পারেনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস , বছরও গড়িয়ে যায়। এক সময় পরেশ জানতে পারে সুপ্রিয়ার বিয়ে হয়েছে মাল্টিন্যশনাল আইটি এন্ট্রারপ্রাইজের এক্সিকিউটিভ।এর সঙ্গে।
একদিন পরেশ কলকাতার অভিনয় ছেড়ে বোম্বে পাড়ি জমায় এক সময়। সুনন্দা বুঝতে পারে, তার স্বামী পরেশ উচ্চাকাঙ্খী।। বিয়ের পর পর পরেশ সুনন্দার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করোয় সুনন্দা মন থেকে সব রকমের অস্বস্তি দূর হয়ে যায়। পরেশের মাও খুশি হয়। তাদের সুখ কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পরেশ বোম্বে গিয়ে শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারে না।পরেশ ভাবে, কলকাতায় ফিরে গিয়ে সুনন্দার সঙ্গে সে ঘর সংসার করবে। কিন্তু বিধিবাম, পরেশ বাড়ি ফিরে এলো। সুনন্দা বাপের বাড়িতে, পরেশের অনুপস্থিতিতে তার বাপের বাড়িতেই থাকারই কথা। পরেশ বাড়িতে এসে দেখল তার বাবা মা দু’জনেই মরণাপন্ন। আজ মরে তো কাল মরে। পরেশের ছোট ভাই রমেশ পড়াশোনা বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরেছ্।শ্বশুর শাশুড়ি মরণাপন্ন , এ কথা শুনে সুনন্দা বাপের বাড়ি গোবরডাঙ্গা মধ্যমগ্রামে এসে বাড়িতে পরেশকে দেখে হতবাক হয়! সে পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মনে হয় বোম্বে থাকাকালে সে গাজা মদ আর মেয়ে মানুষ বাদ দেয়নি।
পরেশের উপর সুনন্দার রাগ হয়, যে স্বামী নিজের বউকে অজলে অস্থলে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে পারে, সে নিজের বাবা মাকে দেখে না সেই স্বামীর সঙ্গে সুনন্দা সহবাস করতে পারবে না কোনক্রমেই।  কয়েকদিনের পরে সুনন্দার শ্বশুর শাশুড়ি মারা যায়। অন্তেষ্টিক্রিয়ার সব কিছুই রমেশ করে।
অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষে সুনন্দা বাপের বাড়িতে ফিরে যায়। পরেশ সে সময়ে সুনন্দার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
কয়েকদিন যেতেই সুনন্দা একটা সুখবর পায়। মধ্যমগ্রামে থাকাকালে সে ওখানকার স্থানীয় এনজিওতে ক্যাশিয়ার পদে আবেদন করেছিল। শ্বশুর বাড়িতে থাকাকালে সে ওখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছিল। তার সুনন্দাকে ওই পদে নিয়োগপত্র মধ্যমগ্রামের ঠিকানায় পাঠানোর খবরটা রমেশ ফোন করে সুনন্দাকে জানালে যেমনটা সে খুশি হয়। অন্যদিক, আবার দু:চিন্তায়ও পড়ে। মধ্যমগ্রামে কি তাকে আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে! সুনন্দা সিদ্ধান্ত নেয় বনগাঁও লোকাল ট্রেনে গোবরডাঙ্গা  থেকে  মধ্যগ্রামে গিয়ে অফিস করবে। সুনন্দার চাকরীর খবর পরেশের কানে যেতে দেরি হয় না। এবার ভাবে , সুনন্দাকে দূরে রাখার কোন অর্থ্ হয় না।
পরেশ সুনন্দার মায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে পরেশ বুঝতে পারে অবস্থা বেগতিক। এতদিন সুনন্দাকে তুচ্ছতাছিল্য করে আসাটা সঠিক হয়নি , পরেশ ভাবে। সে মনে করে মেয়েদেরকে বাগে আনতে হলে আদর, সোহাগ আর একটু ভালবাসার ভান করাই যথেষ্ট।  অথচ পর মুহূর্তে পরেশে ভাবে , এ কথাটাও কিন্তু সঠিক নয়, সে তার বাল্যজীবনের সাথী সুপ্রিয়াকে কি কম ভালবেসেছিল, মনপ্রাণ দিয়ে সে তাকে পেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সুপ্রিয়ার কাছ থেকে কী পেয়েছে। যদি সে অগ্নি সাক্ষীকরা বউ সুনন্দাকে সত্যিকারের ভালবাসতো তবে তাদের জীবন সুখের অর্থ্ হতো। পরেশ মনে করে, সত্যিকার অর্থে সুপ্রিয়ার চেয়ে সুনন্দার সঙ্গের সান্নিধ্যে তার কেটেছিল। পরেশ বোম্বে থাকাকালে তার ছোট ভাই রমেশের বিয়ে হয়, সে সময় ওদের বাবা মা বেঁচে ছিল। সুনন্দা তখন শ্বশুরবাড়ি মধ্যমগ্রামেই থাকত্। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে সুন্ন্দাও দেওর রমেশের জন্য কনে দেখতে গঙ্গার ওপাড়ের উত্তর পাড়ায় গিয়েছিল। মধ্যমগ্রাম স্টেশনের পশ্চিম দিকের শহরে ঢুকবার মোড়ের জনবহুল এলাকার রমেশের স্টেশনারী দোকানটা ছিল পয়মন্ত।বিয়ের পর দোকানটা আরো রমরমা হয়ে উঠল।সুনন্দা মনে হল রমেশের বউ রমা সত্যি সত্যি সংসার করার মত মেয়ে, অন্যদিকে রমেশও সংসারী ছেলে। ওদের বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে রমার কোলজুড়ে একটা ছেলে জন্মাল।
সুনন্দার অফিসের কাছেই রমেশের স্টেশনারী সপ।গোবরডাঙ্গা ফিরবার পথে সময় পেলে সুনন্দা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রমেশের সঙ্গে কথা বলত।তখনো দাদার সঙ্গে বৌদির ডিভোর্স্ হয়নি। সুনন্দা তার একমাত্র দেওর রমেশকে বলে আসছিল সে পরেশকে ডিভোর্সের নোটিশ দেওয়ার কথা ভাবছে, শুধুমাত্র শয্যাশায়ী শ্বশুরশাশুড়ির কথা ভেবে দিতে পারছি না। তাওতো মাঝেমধ্যে তাদেরকে দেখতে যেতে পারছে, রমেশের বউ রমা তাদের যে ধরনের সেবাযত্ন করছে তা দেখে রমার উপর সুনন্দা খুবই খুশি। পরেশ বাড়ি ফিরে আসায় রমেশ ভেবেছিল, এবার হয়তো দাদা বউদির সঙ্গে ঘরসংসার করবে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই দাদার স্বরূপ বুঝতে পারল রমেশ। বাবা মা মারা যাওয়ায় তখন তাদের মাথার উপরে কোন অভিভাবক নেই।পরেশ ও সুনন্দার দুহাত পুনরায় এক করে কে আর দেবে? তবুও রমেশ সুনন্দাকে একদিন বলেছিল,“ দাদা ফিরে আসায় তুমি সন্তুষ্ঠ হওনি বৌদি?” সুনন্দা ভেবে পেয়েছিল সে দেওরের কথার কী জবাব দেবে! তবুও অনেক সময় ধরে সুনন্দা বলে,“ তোমার দাদা কি আজ আর সেই দাদা আছে! ”
চাকরী পাওয়ার পর পরেশের কাছে সুনন্দার দাম বেড়ে যায়। সে একদিন  অফিসে সুনন্দার সঙ্গে দেখা করে তার কাছে টাকা চাইলে সুনন্দা বুঝতে পারে সে তার জীবন থেকে সব কিছু হারিয়েছে। তার হাবভাব দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না সুনন্দার যে তার স্বামী মাদকাশক্ত। ছন্নছাড়া মাদকাশক্ত স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য তার বিবাহবিচ্ছেদের কথা তার কাছে সোজাসুজি পাড়া উচিত, যদি সে বিবাহবিচ্ছেদে রাজি না হয় তবে তাকেই তার স্বামীর বিরুদ্ধে মমলা রজু করতে হবে। সমঝোতার মাধ্যমে ডিভোর্স্ পেপারে পরেশ সই করলে , সমস্যার সমাধান হবে। সুনন্দা এ বিষয়ে আলোচনার জন্য রমেসের সঙ্গে দোকানে দেখা করে ।সুনন্দা তার দেওর রমেশকে বলে,“ তোমার দাদা যদি স্চ্ছোয় ডিভোর্স্ পেপারে সই করে তবে, আমি মাসে মাসে তাকে একটা হাত খরচ দেব, আর সেই টাকাটা তোমার হাতে দিয়ে যাব।। ”
রমেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে দাদাকে ডিফোর্স্ পেপারে সই করাতে রাজি করায়। পরেশের সঙ্গে ডিভোর্স্  হগওয়ার পর সুনন্দা মনে এক ধরনের স্বস্তির আভাস ফুটে উঠলেও মুহূর্তের মধ্যে সুনন্দার মুখে আষাঢ়ের আকাশের ঘনঘটা।
পরেশের সঙ্গে সুনন্দার ডিভোর্স্ এর পর কয়েক বছর কেটে গেছে। তার নিজের বাবা গত বছর মারা গেছেন বার্ধ্ ক্য জনিত কারণে। সুনন্দা বাপের বাড়ি গোবরডাঙ্গায় তার নিজের মা , ছোট ভাই , ছোট ভাইয়ের ভাই এবং তাদের একমাত্র ছেলে মৃন্ময়কে সাথে মিলেমিশে বসবাস করছে।
সুনন্দা মনে মনে ভাবে ,সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল । ঘটনাক্লমে সেই পোড়া ঘরে আজ রাতে একবারের জন্য হলেও তার কি যাওয়া ঠিক হবে ! শেষ পর্যন্ত রমেশে সঙ্গে সুনন্দা পা বাড়ায়। ৥





      




তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

মান্ডলার হান্টেড কাহিনী
                                                           

বিশ্বাস অবিশ্বাস  কি শুধু মনের ব্যাপার ? অনেকে তাই মনে করেন বটে। এমনটাও দেখা যায় কেউ কেউ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন কিন্তু প্রকাশ করে সবার সমক্ষে নিজেকে দুর্বল করতে চান না। আরও একটা দিক আছে--আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাতে অবিশ্বাস্য কিছু ঢুকে গেলে তা ব্যাহত হয়। আমরা সবাই চাই জীবনের একটা সুষ্টু ধারাপ্রবাহ। চাইলেই সব কিছু হয় না, কিছু কিছু অস্তিত্ব আছে যা জীবনকে আচমকা নাড়া দিয়ে যায়। লৌকিকতার মাঝে অলৌকিকতা ঢুকে যায়। আমরা হতবাক হই, বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ি। সে সব অবুঝ অস্তিত্বগুলি নিয়ে লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন ও তার উত্তর খুঁজে ফিরি। ভূত, ভৌতিক, রহস্য, অলৌকিকতা এ সব শব্দগুলি আমরা যেভাবেই উচ্চারণ করি না কেন আখির তা বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্যায়ে এসে ঠেকতেই পারে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আমি কিন্তু কোন রকম তর্ক বিতর্কে যেতে চাই না। আমি শুধু কিছু নির্দিষ্ট নির্বাচিত হান্টেড ঘটনাকে নতুন ভাবে নিজের মত করে সাজিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। এ সব ঘটনাগুলির বেশ কিছু ঘটনা কিন্তু স্থান কাল পাত্র আগে ভাগেই চিহ্নিত হয়ে আছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সে সব ঘটনা সারা বিশ্বে আজ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনি বহু ঘটনার মাঝে বর্তমান পর্বে মধ্যপ্রদেশের মান্ডলা জেলার ভৌতিক, অলৌকিক বা হান্টেড কিছু ঘটনা গল্পাকারে প্রকাশ করছি--          
                                                                   
                                                                  

                                                                 সিগারেট

আমি তখন সবে মাত্র মান্ডলার না গ্রাম না শহর ধরণের একটাজাগায় সরকারি স্তরের চাকরিতে জয়েন করেছি। মান্ডলা মধ্যপ্রদেশের এক অরণ্য প্রধান জেলা। এ খানেও দিনে চহল পহল লাগা থাকলেও সামান্য রাতেই নির্জনতা ঘিরে যায়। একটু দূরে হলেও এর চার পাশ গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। এতটা ইন্টেরিয়রে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমায় আসতেই হয়েছিল এখানে। ছোট একটা তৌশীল অফিস। আমার বাসস্থান থেকে আধ কিলোমিটার দূরে হবে। অনেকটা খাপছাড়া ধরনের লোকালয়ে আমায় থাকতে হতো। প্ল্যান করে এখানে ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট বানানো হয় নি।
মোটামুটি পছন্দ মত ভাড়ায় একটা বাড়ি পেয়ে গিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে জঙ্গল দু শ মিটার দূরত্ব হালকা বনের সীমানা শুরু হয়ে গেছে। পাশেই ছিল একটা সরু নদী। গ্রীষ্মে হাঁটুজল কোথাও কোথাও পায়ের পাতা জল থেকে যায়। তবে বর্ষায় তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়--ফুলে ফেঁপে কলকল ছলছল শব্দ করতে করতে সশব্দে সে বয়ে যায়। ঘর থেকে সামান্য কিছুটা গেলেই পরে নদীর পুল। স্থামীয় লোকেরা এ পুল একেবাই ব্যবহার করে না। এই পুল নিয়েই ইয়ের ভীতি জড়িয়ে আছে। কিসের ভয় বা ভয়ের কোন ঘটনার কথা কেউ বলতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা এ পুল দিয়ে যাতায়াত করেন না কেন ?
আমি বলতে পারবো না,তবে স্হানেছি এ পুলের বড় নাম আছে। অনেকে ভয় পেয়েছে রাতে পুলের ওপর পা রাখলেই নাকি গা ভারী ভারী লাগে। শরীর ছমছম করে ওঠে। ব্যাস এই পর্যন্ত ভয়ের ইতিহাস শুনে ছিলাম। আমি আমার নিজের মন থেকে,ফুঁ বলে অবিশ্বাসে মন থেকে ও সব ভয় ভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে ছিলাম।   
ঘর থেকে অফিসের দূরত্ব আধ কিলো মিটার থেকে একটু বেশী হবে। আমি কিন্তু নির্ভয় ছিলাম দিব্বি পুল পার করে শর্টকাট পথ ধরে প্রতিদিন পৌঁছে যেতাম আমার অফিসে। পুলের বদনামের কথা বেমালুম ভুলেও গেলাম। দিনের বেলায় রোজ যাই আসি এতে ভয়ের আছেটা কি ?শুরুতে দু একজন আমায় সতর্ক বার্তা দিয়েছিলো বটে,কিন্তু আমি ছিলাম ডোন্ট কেয়ার--
একদিন হঠাৎই অফিসে ইমার্জেন্সী কাজ এসে পড়ল। বস আমাকে ডে র বদলে নাইটে কাজে জয়েন করতে বললেন। এই প্রথম বার রাতে আমায় অফার করতে যেতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে অভ্যাস মত নদীর ধারে পুল পার করবো বলে এসে দাঁড়ালাম। না মনে ভয় ছিল না। রোজি তো পারাপার করছি পুল,তবে আর ভয় কিসের ? রাত বলে ? মনে মনে ধুস,বলে পুলে পা রাখলাম। অন্য্ দিনের মত আমি রাতেও স্বাভাবিক পা ফেলে ফেলে পুল পার হচ্ছিলাম। আর কয়েক স্টেপ দিলেই পুল পার হবো,ঠিক এমনি সময় আমি পেছন থেকে স্পষ্ট একটা ডাক শুনতে পেলাম,কেউ যেন বেশ গভীর আওয়াজ নিয়ে আমায় ডাক দিয়ে উঠলো,কি আশ্চর্য আমার নাম ধরেই কেউ যেন আমায় ডাকলো, এই প্রদীপ শোন--
আমি চকিত হলাম,মনে মনে ভেবে নিলাম না আমার নাম জানার মত এখানে কেউ তো নেই !
পেছন ফায়ার দেখলাম একটা মাঝ বয়সী লোকের চেহারা--এই আমার থেকে হাত আট দশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চেহারা তত স্পষ্ট নয়,নরমাল সাদাটে পোশাক পরা। ওর হাত দুটির ওপর আমার নজর এলো, দেখলাম গাঢ় কালো ছায়ার মত তার দুটি হাত। ঈষৎ হাত বাড়িয়ে সে আমায় বলল, এই একটা সিগারেট দেও তো--
গলার আওয়াজ বেশ ভারী। তার হাতদুটি তার শরীরের তুলনায় বেশ লম্বা বলে মনে হল। আমি স্মোক করি না, তখনও কিছু ভাবতে পারছিলাম না,খানিক চুপ থেকে বললাম,আমার কাছে সিগারেট নেই--
লোকটা যেন হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অফিসে যাবো বলে নিজের তাড়নায় থাকার কারণেই হবে বোধ হয় আমি নির্দ্বিধায় আবার অফিসের দিকে পা বাড়ালাম। আর দু পা বাড়িয়ে পুল পার করতে যাচ্ছিল,ঠিক সেই মুহূর্তে বেশ জোর গলায় পেছন থেকে লোকটা বলে উঠলো, প্রদীপ,কালকে মনে করে আমার জন্যে সিগারেট আনিস কিন্তু ! এবার আমি চমকে উঠলাম গলার আওয়াজে বুকের মাঝখানটা যেন আমার একবারের জন্যে কেঁপে উঠলো। 
--মনে করে এমনি সময় পুলের ওপরে এসে আমায় দিয়ে যাস, কঠোর ও গম্ভীর শুরে লোকটা আবার বলে উঠল।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম,ভয়ে আমার মুখ থেকে কোন কথা সরছিল না। দ্রুত অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম। অফিসে আমনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। তাকে সব কথা খুলে বললাম। সে বলল,ওই পুলের বদনামের কথা অনেকবার শুনেছি,তুই আর ওই পথে আসিস না।
পরদিন আমিনকে আমার ঘরে ডাকলাম। ওকে জানিয়ে ছিলাম যে আজ রাতে আমি ওই লোকটার হাতে সিগারেট তুলে দেব। ও ভয়ে ভয়ে বলে ছিল,কি পাগলামী করছিস ?তবু আমার ইচ্ছা বেশ দৃঢ় ছিল।রাতে আমলকে পুল থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে আমি ধীরে ধীরে পুলের ওপর চড়লাম।আমি তখন মাঝ পুড়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে এপাশ ওপাশ মুখ ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি তবু মুখ তুলে বলে উঠলাম,আপনার সিগারেট এনেছি--আমি হাত বাড়িয়ে একটা নয় গোটা এক প্যাকেট সিগারেট শূন্যে তুলে ধরলাম--
যেন দূর থেকে মহাকালের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো, হ্যা, প্রদীপ, এই যে আমি নিচ্ছি--কেউ আমার হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলো বুঝতে পারলাম। পরক্ষনেই একটা কালো অবয়ব আমার সামনে ভেসে উঠলো, উচ্চারিত হল,থ্যাংকস--
তারপর আর কিছু নেই।
                                                                            

                      

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনী পর্ব

শহর কে আমোদিনী বুঝিতে পারে না।তাহার যৌবন কাটিয়াছে পল্লীতে। সে প্রবল ক্ষুধা দেখিয়াছে। সর্প দংশনে শক্ত সমর্থ স্বামীর মৃত্যু দেখিয়াছে।তথাপি সে  সকল কিছু বুঝিতে সক্ষম ছিল। পল্লীবাস কালে কষ্ট থাকিলেও সে বড় মুক্ত ছিল।পুত্র তারাপদর দ্বিতীয় বিবাহ হল আধা শহরের কন্যা মিলির সহিত। মিলি শহর বুঝিতে পারে। মিলি পল্লী জীবনের সরলতায় বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠিল।নিত্য বিবাদে তারাপদ স্থির করিল এবার সে শহরে যাইবে। তারাপদ  তার মাতৃদেবী কে লইয়া আসিল। শহরে মাথা গুঁজিবার অন্ধকারময় খুপরি হস্তগত হইল।জীবিকা পাইল তারাপদ, মিলি পাইল নাইটি পরার স্বাধীনতা, আর আমোদিনী পাইল বদ্ধতা। চোখের দৃষ্টির ন্যায় তাহার ঘ্রানেন্দ্রিয় টির ক্ষমতা কিছু যদি কম হইত তাহলে যাতনা কিছু কম হইত।আবর্জনার দুর্গন্ধের পাশে রন্ধন করিতে হয়। মদ্যপান রত দের নিত্য হল্লা শব্দে গভীর ঘুম হইতে চমকাইয়া উঠিয়া সে হাঁপাইতে থাকে। পল্লীর ক্ষুদ্র পুষ্করিণী, বৃক্ষরাজি, মুক্ত আকাশের কথা , ভাবিয়া চোখে তাহার জল চলিয়া আসে।পানীয় জলের লাইনের নিত্য কলহ, চারিপাশে অবিরাম যান্ত্রিক গোলযোগে সে  হতভম্ব হইয়া পড়ে। ইতিমধ্যে তারাপদ বুঝিতে পারে শহরে তারপক্ষে একাকী অন্নসংস্থান করা সম্ভব নয়।মিলি নিয়ত অনুধাবন করিতে লাগিল শহরে জীবন অধিক জটিল। যাহা সে বুঝিতে পারিলেও উপভোগ করিবার সামর্থ্য অর্জন করে নাই।মিলিও নাতি দুরের ফ্ল্যাট বাড়িতে রন্ধনকার্যে নিযুক্ত । এই তিনটি গ্রাম্য মানুষ প্রতিনিয়ত শহরের বুদ্ধিমত্তার কাছে নিজ সরল মনন কে হাস্যস্পদ  প্রতিপন্ন হইতে দেখে।

একদিন রাত্রিকালে অন্ন গ্রহণ কালে তারাপদ বলিল, “মা তুমার জন্নি একখান কাজ পেল্যাম। তুমি ঘরে যেমন বসে থাকো ওখানেও তুমি ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে থাকবে।” আমোদিনী বুঝিতে পারিল তাহাকে শেষ বয়সেও উপার্জন করিতে হইবে। সেই হইতে আমোদিনী ভি আই পি রোড পারাপার করিবার ভূগর্ভস্থ শান বাঁধানো পথ টির একপাশে হাত পাতিয়া বসিয়া থাকে। রাত্রি দশ ঘটিকায় তারাপদ কাজ শেষ করিয়া উপার্জন শীলা মাতা কে লইতে আসে। আমোদিনী কেবল পা দেখে। কেহ দ্রুত যায়, কেহ খুঁড়িয়ে হাঁটে , গট গট করিয়া যায় কেহ।আমোদিনী বোধ শূন্য অবস্থায় কেবল দক্ষিণ হস্ত টি পাতিয়া থাকে। শহর তাহার পাশ দিয়া বসিয়া থাকে। শহর তাহার পাশ দিয়া কেবল বহিয়া যায়।

আজ তাহার মন কেবল গ্রামের ছোট পুষ্করিণীটার কথা মনে হইতেছে। তাহার চারপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বালিকা কালের মতো ছুটিয়া বেড়াইতেছে। হাতে কেহ পয়সা ফেলিয়া চলিয়া গেলে ঘোর কাটিয়া গেল। অবাক হইয়া আমোদিনী বুঝিতে পারিল সে সব কিছু পুর্বের চাহিতে স্পষ্ট দেখিতেছে।আজ সে না বলা কথাও অনুধাবন করিতেছে।  যে লোক টি পাঁচ টাকার কয়েন ফেলিয়া গেল তাহার কন্যার অসুখ।হাইহিলের দশটাকা দান করিয়া চলিয়া যাওয়া মহিলা টি অদ্য প্রেমিকের সহিত হেস্ত নেস্ত করিবে । আমোদিনী র নাসিকা তে কোন দুর্গন্ধ বোধ নাই।

রাত্রি দশ ঘটিকায় তারাপদ তাহার মাতাকে লইতে আসিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়া কাঠ হইয়া পড়িয়া থাকা আমোদিনী গায়ে হাত দিয়া সে প্রমাদ গনিল।আমোদিনী বালিকা বেলার ন্যায় সিঁড়ি দিয়া দ্রুত উঠিতেছে, নামিতেছে। উঠিতেছে, নামিতেছে।               
               

          

পার্থ রায়

এক চিলতে উষ্ণতা   

সকালটা আজ অন্য রকম ভাবে শুরু হোল মানসীর। গতকাল রাত থেকে এখন দিন সাতেক মানসী এই ফ্ল্যাটে পুরো একা, অনেকদিন পরে নিজের মতো করে একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকা। ছেলে রুমন, বৌমা রঞ্জাবতী আর বছর আটেকের নাতনী তিন্নি গেছে দারজিলিং, কালিম্পং হয়ে লাভা লোলেগাঁও।বরাবরই মানসীর ভোরে ওঠা অভ্যাস। ব্যাল্কনির টবে জল দেওয়া দিয়ে দিনের শুরু।সকাল বেলা স্নান সেরে নেওয়াও একটা পুরনো অভ্যাস। একা একা নিজের জন্য রান্না করতে ভালো লাগেনা। ডালিয়াতে যাহোক কিছু সব্জি দিয়ে আজ দুপুরের খাওয়া সেরে নেবে।বাতাসে হিমেল ভাব শীত আসার বার্তা দিচ্ছে।শীত আসার আগে আলমারি থেকে গরম জামা কাপড় গুলো রোদ্দুরে দেওয়াটাও মানসীর বহুদিনের অভ্যাস। একটু লিকার চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে শোয়ার ঘরে এলো মানসী, আলমারিটা খুলল।ওপরের তাক থেকে এক এক করে গরম জামা কাপড় গুলো নামাতে গিয়ে দু চোখ আটকে গেল, বুকের মধ্যে এক ঝলক ফাগুনি হাওয়া যেন উদাস দোলা দিয়ে গেল। এক পলকের জন্য নিথর হয়ে গেলো মানসী- অর্জুনের সেই শাল। ভুলেই গিয়েছিল। ধীর হাতে শালটা তুলে নিল, নরম করে একবার হাত বোলাল শালটার গায়ে।শুধু তো একটা শাল নয়, ওটার সাথে যে অনেক মায়াময় মুহূর্ত জড়ানো আছে। কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল মানসী।
রিটায়ারমেন্টের বছর তিনেকের মাথায় অনির্বাণের অসময়ে চলে যাবার পরে বিধ্বস্ত অসহায় হয়ে পড়েছিল মানসী। রুমন তখন সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা নামী ফার্মে জয়েন করেছে। জয়েন করার মাস কয়েক পরেই ওকে চেন্নাই পাঠানো হোল এম বি এ করতে। মানসী আরও একা হয়ে পড়ল। রুমন যাবার আগে মাকে শুধু একটা ভাল অ্যানড্রয়েড ফোন কিনেই দেয়নি, ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে তার কায়দা কানুন বেশ যত্ন করে শিখিয়ে দিয়েছিল।প্রথম দিকে বেশ ভয় ভয় করত মানসীর।তবে কোন অসুবিধা হলে চেন্নাইতে থাকা রুমানের থেকে জেনে নিত।  
এইভাবে বেশ কিছু বন্ধু হয়ে গেছিল, এইভাবেই অর্জুনের সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব। বেশ কবিতা, ছোট ছোট গল্প লিখে পোস্ট করত। মানসী খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ত। মানুষটার মধ্যে একটা সহজ সরল আন্তরিকতা ছিল। সময়ের সাথে সাথে কখন যে বন্ধুত্বের গণ্ডী অতিক্রম করে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক মন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল, দুজনের কেউই টের পায়নি। কোনদিন খুব বেশী পারিবারিক ব্যাপার জানতেও চায়নি, বলতেও চায়নি অর্জুন। ভালবাসি না বলেও যে কতো সুন্দর করে ভালোবাসার স্পর্শ হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে দেওয়া যায় সেটা মানসী অর্জুনের কাছ থেকে শিখেছিল। একাকীত্বের খোলস ছেড়ে এক অজানা স্বপ্নের গ্রহের বাসিন্দা হয়ে পড়েছিল মানসী। অদ্ভুত এক মাদকতা ছিল অর্জুনের। ঘনিষ্ঠতায় শরীরকে প্রাধান্য না দিয়ে তার থেকে অনেক বেশী যেন নিরভরতা দিয়েছিল মানসীকে ও। কোন দিন শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেনি অর্জুন। সৌম্য চেহারার সাথে ওর ব্যাক্তিত্ব, আচার আচরণ যেন খাপ খেয়ে গেছিল। শেষের দিকে ফোনেও কথা হতো। মানসী মাঝে মাঝে অবাক হত, এ কেমন পুরুষ? কোন দিন দেখা করতে চেয়ে নিজে অস্থির হয়নি, মানসীকেও বিব্রত করেনি। বরংচ মধ্য বয়েসি বিধবা মানসীরই মনের কন্দরে মানুষটার সাথে দেখা করার সুপ্ত সাধ ছিল, একবারের তরে হলেও। ইতিমধ্যে রঞ্জাবতী এলো, তিন্নি এলো, বাড়ী বদল হোল।মাঝে মাঝেই নানা আকারের ছেদ পড়ত সংযোগে উভয়ের তরফ থেকে।তারপরে তো দীর্ঘ বছর তিনেক বেমালুম উধাও হয়ে গেল মানুষটা।ইন বক্সে উত্তর না পেয়ে, ফোন করেছিল মানসী। অদ্ভুত এক অজানা কণ্ঠ জানান দিল সেটা তার নাম্বার, কোন অর্জুন বাবুর নাম্বার নয়।গরু যেমন গোধূলি শেষে গোয়ালে ফিরে জাবর কাটে, রোজকার জীবন যাপনের মাঝে মাঝে নিরালা দুপুরে অথবা রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে মানসী স্মৃতির জাবর কেটে যায় পরম মমতায়।নিসৃত দীর্ঘশ্বাস শোয়ার ঘরের দেওয়ালে আছড়ে পড়ে।      
পাহাড় থেকে সমুদ্র বরাবরই বেশী টানে মানসীকে।সমুদ্র যেন অনেক গভীর, অর্জুনের মতো-পাহাড় যেন উদ্ধত, অহংকারী বড়।তাই সেবার যখন রুমন, রঞ্জাবতীরা পুরী যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করল, মানসী রাজি হয়ে গেছিল।
সেদিন ওরা সাইট সিয়িংএ গেলো, ফিরবে সেই রাত আঁটটা নটার সময়।বিকেলের দিকে হোটেলের ঘরে তালা মেরে গুটি গুটি পায়ে সমুদ্রের ধারে নিজের মনে হেঁটে যাচ্ছিল মানসী, বিচের ভিড় ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে- যেখানে জেলেদের নৌকাগুলো রাত জাগার শেষে বিশ্রাম নেয় সেইদিকে।হঠাৎ একটা উদাত্ত কণ্ঠের কবিতা শুনে সচকিত হয়ে উঠল মানসী, বড় চেনা সে গলা।
বুকের মধ্যে একটা উথালি পাথালি নিয়ে দ্রুত পায়ে নৌকা গুলো ছাড়িয়ে এগুতেই দেখতে পেল একটা নৌকার আড়ালে সাদা শাল গায়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পড়া এক শালপ্রাংশু অবয়ব দুহাত মেলে সব চরাচর ভুলে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে।
“অর্জুন”- এক আকুল স্বতঃস্ফুর্ত চিৎকার মানসীর বুক চিরে বেরিয়ে এলো।কবিতা থেমে গেছিল।গোধুলীর রঙ দুজনের মুখেই মাখামাখি হয়েছিল।
তারপরে সময় কোথা দিয়ে চলে গেছিল, ওরা টের পায়নি।পাশাপাশি বসে কথার কলকাকলি, মানসীর রবীন্দ্র সঙ্গীতে, অর্জুনের আবৃত্তি দুই প্রাচীন মনকে নবীন করেছিল।অভিমানও ভর করেছিল মানসীর গলায় ওকে না জানিয়ে অর্জুনের হারিয়ে যাওয়ায়।বিষাদ মাখা হাসি মুখে এনে অর্জুন বলেছিল, “আমারও কি কষ্ট হয় নি তোমায় না জানিয়ে সরে যেতে? থাক সেসব কথা।তুমি ছিলে তো আমার কাছে যেমন আমি ছিলাম তোমার অন্তরে”। মানসী আর কথা বাড়ায় নি।
কখন সূর্যটা তার ডিউটি চাঁদের হাতে সঁপে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল, গায়ে গায়ে বসে থাকা অর্জুন মানসী টের পায়নি।একটু খুশখুশে কাশি হয়েছিল মানসীর, গায়ের শালটা খুলে পরম মমতায় মানসীর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়েছিল।আপত্তি করেনি মানসী, হরিণের কোমল চাউনি মেলে অর্জুনের কাঁধে মাথা রেখেছিল।
“ দাদু, এবার চলুন।দেরী হলে হোমের ম্যানেজার বাবু রাগারাগি করবে”- পেছন থেকে আসা একটা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে দুজনে সরে বসেছিল। যেন এক জল্লাদ মুহূর্ত গুলোর মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল।বিব্রত চাউনি নিয়ে অর্জুন বলেছিল, “অক্সিজেন নিয়ে গেলাম ফুসফুস ভরে।তুমিও আর থেকো না এখানে। ভালো থেকো মানসী, শরীরের যত্ন নিও। আসি”
আচমকা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল মানসী।ভাঙ্গা গলায় কোন মতে বলেছিল, “ হুম, এসো, তুমিও ভাল থেকো”।
আলো আঁধারি মেখে শালপ্রাংশু অবয়বটা মানসীকে একা রেখে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।শালটা ফেরত দেবার কথা ভুলে গেছিল, ভুলে গেছিল ফোন নাম্বারটাও নিতে।অবশ্য চাইলেও হয়তো ফোন নাম্বার পেত না। হোটেলে ফিরে নিজের ব্যাগের তলায় সেই শাল লুকিয়ে রেখেছিল।
         একটা সাইলেন্সার কাটা অটো রিক্সার বিকট আওয়াজে মানসী স্মৃতির পাতা থেকে বর্তমানে ফিরে এল।শালটা পরম মমতায় গায়ে জড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে আলমারির আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল কিন্তু ঝাপসা দৃষ্টিতে আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল না।
বাস্প রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, "আমার ছোঁয়া টের পাচ্ছ, অর্জুন?"



অলভ্য ঘোষ

ভাগ
                                                                                                           

চ্যানডোবার মাটিতে এত বড় কোনো ঘটনা নয়। সামন্তদের বড় ছেলেটা জুট মিলে কাজ পেয়ে যখন কলকাতা থেকে বউ নিয়ে এলো; জমি ভাগ বসিয়ে বাপ মা মরা অসহায় ছোট ভাইকে একা করে রাত পোহাতে পোহাতে ভিটেমাটি বেঁচে পালালো কলকাতায়। কয়েকদিন বটতলায় চায়ের দোকানে মুরব্বিরা চায়ের কাপ মুখে ধরে হুঁকোয় টান মেরে এ ঘটনার সমালোচনা করল বটে; তবে কিছুদিনের মধ্যেই জল থিতল । নুরুলের নিকাকে আলোচনার বিষয় করে নিলো । খাল পাড়ের এক চিলতে এঁদো জমিটা জুটল খাদিজা বিবির নসিবে । কালে কালে এ জলো গড়িয়ে গেল এদের মন থেকে। গাঙে আবার নতুন ঢেউ এসে জমা হল

আজ সুবল ও বিমলের ভাগবাটোয়ারার দিন। এরা কাকা ও ভাইপো হলেও নাড়ির টান ছিল সহোদরের মত। গ্রামের লোকেরা অনেকেই এদের সম্পর্কের প্রগাঢ়তায় জ্বলে পুড়ে মরত। পরশ্রীকাতরতা ও পরচ্ছিদ্র অন্বেষণে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার । তবে প্রিয় পাঠক সুবল-বিমলের সম্পর্কের মাঝে প্রতিবেশীর কান ভাঙানি,
 আত্মীয়ের উস্কানি কতটা মোটা বিভেদের পাঁচিল গেঁথে ছিল সেটা এ গল্পের উপজীব্য নয় । এই সংসারের বৈষয়িক সম্পত্তির কঠিন গরাদে আটকে পড়া নিকট হৃদয়গুলো কক্ষচ্যুত ধূমকেতুর মত হঠাৎ  আলোক বর্ষ দূরে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েও; কোন মাধ্যাকর্ষণের টানে তারা আবার ফিরে আসে আপন আপন কক্ষপথে তারা একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে । কেমন করে কোনটা বা পৃথিবীর বুকেই আছড়ে পড়ে আবেগে। এই গল্পে তার অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে চলেছি ।

জানি না আজ সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এ সংসারের কতটা প্রবল। তবে সে শক্তি একেবারে না থাকলে আমরা এ পৃথিবীতে এঁটুলির মত আটকে থাকতাম না । কেন হঠাৎ
 শরৎ চাটুজ্যে মার্কা সংসারের গল্প লিখতে বসলাম বলুন তো ? কারণ আজকের সংসারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থেকে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার; ম্যায় তুম অর মেরা বেটা তেও দাঁড়িয়ে নেই। ম্যায় তুম অর ও। আরো ত্রিকোণ সম্পর্ক এসে ভিড় করছে । সম্পর্কের টানাপোড়নে ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক, ব্যক্তিক জীবনে বিভাজিত হতে হতে আরো বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। অথচ বনের পশুরাও সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করেন। বানরের দল দেখেছেন তো । অ্যানিমেল প্লানেট খুলে দেখুন সিংহ পরিবার কি রকম একটা শিকার ধরে ভাগ ঝোঁক করে ভোজ সারছে । অথচ আমরা মানুষেরা কেবল নিজেরা খেতে ব্যস্ত। বনের পশুরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিকার মারে না। আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভবিষ্যতের সংগ্রহে শিকারে লিপ্ত । নিজেরাই শিকার হয়ে পড়ছি অমানবিকতার। পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর আমরা । সেই অমানবিকতা থেকে মানবিকতার আলোর উৎসের সন্ধানে এই গল্প ।

পর্ব-১
কায়স্থ বোস । এক কাঠি নিচে নেমে সুবল যেদিন বেরার মেয়ের সাথে ভাব জমাল ; পাঁচ কান হয়ে কথাটা পৌঁছেছিল বৌদিমণির কানে ।
অনেকে খোঁচা মেরে বলেছিল;
-"ওতো তোমার পেটের ছেলে নয় ।"
কারো কথা কানে না তুলে অনাথ বন্ধু বেরার বাড়ি নিজেই গিয়েছিল বৌদিমণি সুবলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । লোকে ছিঃ ছিঃ করলে বলেছিল;
-"জাত ধুয়ে কি জল খাব। জল খাব মেয়ের হাতের।  সুবলের যে মেয়ে পছন্দ; সে তো আমার পরিবারের অযোগ্য হতে পারে না।"
বাড়িতে সুবলকে বলেছিল;
-"হ্যাঁরে সবিতার সাথে ভালবাসা করলি কই আমাকে তো বললিনে !"
সুবল বৌদিমণিকে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা রেখে বলেছিল;
-"ভয়ে যদি তুমি মেনে না নাও ।"
মনিমালা একগাল হেসে সুবলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল;
-"দুর পাগল! তুই আর বিমল আমার প্রাণ। প্রাণ ছাড়া এই দেহের কি কোন অস্তিত্ব আছেরে ।"
সুবল বৌদি মণির কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে ছিল । তার একমাত্র আশ্রয়স্থল এই বৌদিমণি। মায়ের স্নেহ; বন্ধুর সাহচর্য পেয়েছে সে তার কাছ থেকে ।

পর্ব-২
পনের বছর বয়সে মনিমালা এই পরিবারের বউ হয়ে এসেছে । সতের বছর বয়সে মা হয়েছে। তিরিশ বছর বয়সে বিধবা একের পর এক মৃত্যু গ্রাস করেছে এই ভিটেকে। সংসারের একের পর এক হাল ধরতে হয়েছে মনিমালাকে । নিজের হাতে তিলে তিলে গড়েছে সে এই সংসার । শাশুড়ি মা মারা যাওয়ার সময় মনিমালার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছে তার জীবিত শেষ সন্তানটি। মৃত্যুর পথযাত্রী শাশুড়িকে মনিমালা কথা দিয়েছিল সুবলের সে অযত্ন করবে না কোনদিন । কথা রেখেছে মনিমালা; নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি সুবল তার কাছে । মনিমালার স্তনে সেদিন দুধ ছিল না । সদ্যজাত সুবলের কাজের মাসির বুকের দুধ খেয়ে প্রাণ রক্ষা হয়েছিল ।

সুবল আর বিমলের বয়সের ফারাক মাত্র কয়েক বছরের । বিমল যখন আতুর ঘরে বোয়াল মাছের মত মাতৃদুগ্ধ পানে লিপ্ত থাকতো । আঁতুড় ঘরের চৌকাঠে হামা দিয়ে এসে হাজির হতো সুবল। কাঙালের মতো একটা শিশু আরেকটা শিশুর দুগ্ধ পানের দৃশ্য দেখত বিস্ময় দৃষ্টিতে । মনিমালার মা সেসময় মেয়ের যত্নআত্তির জন্য এ বাড়িতে এসেছিল দীর্ঘদিন । তার কড়া নিষেধ ছিল; চৌকাঠ পেরিয়ে আঁতুড় ঘরে ঢোকা যাবে না সুবলের। সুবলকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যেতো মনিমালার মা। সুবল কাঁদত! আর উঠানে খেলতে খেলতে আবার হাজির হতো । উঠানের পাশের তাদের গোয়াল ঘর ঘিরে নির্মিত অস্থায়ী আঁতুড় ঘরে। এ আঁতুড় ঘরের সুবল ও একদিন অংশীদার ছিল। সদ্য বিয়ানো শিশুর আস্তানা গোয়াল ঘরে। এটা এ বাড়ির পরম্পরা। গোয়াল ঘরে সুবলের জন্মের পর মনিমালার শ্বশুর মশাই এসে সুবলকে দেখে বলেছিলেন;
 
-"এঁড়ে বাছুর। মাটাকে খেলি। এবার বাঁচবি কেমনে ?"
শেষ রক্ষা হয়েছিল ।
সে যাই হোক। আঁতুড় ঘরে মনিমালার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠতো । নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতো তার। সে যে এক মৃত্যু পথগামী মানুষকে কথা 
দিয়েছে;  সুবলকে পরিপূর্ণ মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলবে।মাতৃ দুগ্ধ সন্তান কে না খাইয়ে মা হওয়া যায় ?
মনিমালার মা তার মেয়েকে উপদেশ দিয়েছিল ।
-"সন্তানের কাছে মায়ের দুধ হল অমৃত। কথায় বলে দুধের ঋণ শোধ হয় না। সে দুধ তুই নিজের সন্তানকে না খাইয়ে ওই পোড়ার মুখটাকে ভাগ দিবি না মনি ।"
মায়ের কথা রাখতে পারেনি মনিমালা। সুবলের প্রতি বঞ্চনা তার ধর্মে সইবে না । কয়েকদিনের মধ্যেই মনিমালা সুবলকে টেনে নিয়েছিল বুকের উপর। সুবল ও বিমলের সাথে ভাগ বসিয়ে ছিল মাতৃদুগ্ধে ।

কোন স্তনে ঠুনকো হলেও মনিমালা কখনো তার স্তনসুধা থেকে বঞ্চিত করেনি তার সন্তানদের । সকল যন্ত্রণা সহ্য করে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে এদেশের মায়েদের আত্মগৌরব ছিল একদা; তা পুনরুদ্ধারের কথা বললে জানি প্রবল নারীবাদীরা বলবেন; কেন মনিমালাদের সম্পূর্ণ বিলতে হবে এত অমানবিক । মায়ের মানবিকতা কেবল সন্তানদের জুড়ে । আর নারীর পূর্ণতা মায়ে। প্রকৃতি সে শক্তি পুরুষকে দেয়নি ।  এ সংসার সৃজন বন্ধন মায়ের হাতে ।  মা নারীর উচ্চাঙ্গের রূপ। জানি এতেও এক অংশের নারীবাদীরা বলবেন নারীকে পেল্লাই দিয়ে পুরুষ তুমি আখের গোছাতে চাইছ। তাকে মুক্তি দাও! নারীর মুক্তি মাতৃত্বে। একবিংশ শতাব্দীর মায়েরা যদি মা হতে না চান; টেস্ট টিউবে সমাজ টিকবে তো ? মাকড়সার মধ্যে যেমন সঙ্গমের পর পুরুষ মাকড়সাটাকে নারী মাকড়সা খেয়ে ফেলে; আমরা তেমনি নারীকেও সংসারে সুখ ভোগের পর ছিবড়ে করে দীর্ঘদিন হত্যা করেছি । তবুও বলি আজ যে স্বাধীনতা নারী কিঞ্চিত হলেও পেয়েছে; সেটা কি আদায়কৃত ? না পুরুষের দেওয়া ? 

সেটা ভেবে দেখবেন দয়া করে। বিদ্যাসাগর একজন পুরুষ ছিলেন।নারীবাদী ছিলেন কিনা আমার জানা নাই; তবে নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের জন্য তার উদ্দাম
ছিল। নারী পুরুষের সমতা বা সামঞ্জস্য এক উন্নত সমাজের পরিকাঠামো স্থাপন করতে পারে এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।

এ দেশে নারী চিরকাল পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকেছে। স্বাধীনতা আত্মার নিজেকে জাগিয়ে তোলার। নিজের অধিকারটা বুঝে নেওয়ার। পাওনাদারের মত না হলেও তাকে তার নিজের সম্মান অবশ্যই আদায় করে নিতে হবে। পুরুষের করুণার অপেক্ষায় নয়। পুরুষ তার সংসারের প্রয়োজনেই নারীকে হেঁশেল থেকে আজ ঘরের বাইরে ছেড়েছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেও স্বাধীনতা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অফিসের বস ঘরের স্বামীর মতই ব্যবহার করে কর্মস্থলে নারীর সাথে।

পর্ব-৩
ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে স্বাধীনতা মানে আধুনিকতা মানে বাইরের কিছু নয় ভেতরের। আবার দেখি স্বাধীনতা আধুনিকতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা। নারী এমন পোশাকে রাস্তা মেট্রো স্টেশনকে ফ্যাশন র‍্যাম্প ভাবতে শুরু করেছে যে আসলে সে একদল পুরুষ তাকে যে ভাবে দেখতে চায় সেই ইচ্ছা পূরণ করে নিজেকে সাজিয়ে চলেছে। যুগ যুগ ধরে নারীকে পণ্য ভাবা হয়েছে। এখন নারী পণ্য বলেই নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখে গেছে। তাদের জন্ম যে অপরের মনোরঞ্জনের জন্য নয়; সংসারের লালন পালনের জন্য তাদের জন্ম; এটা যেদিন তারা বুঝতে পারবে সেদিনই নারীর মুক্তি সম্ভব। নারীকে দশ হাত দিয়ে পূজা করা হচ্ছে সংসারে খাটিয়ে নেবার জন্য নয় সংসার রক্ষার জন্য ! কু কে দমন করে সু এর প্রতিষ্ঠার পূজা তো দুর্গা পূজা বলে জানি।

সে ভাগ ছিল স্নেহের ভাগ। বিমলের সাথে সুবল যতই ভাগ বসিয়েছে মনিমালার বুকে; মনিমালার বুকের স্নেহ বেড়েছে ততই। আসলে সুবল ও বিমলকে মনিমালা কখনো পৃথকভাবে দেখেনি।
কিন্তু আজকের ভাগ অখণ্ড একটা হৃদয়কে দু’টুকরো করে বখরা নেওয়া। এ হৃদয় মনিমালার।
প্রতিবেশীর কানভাঙানি; সর্বোপরি মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সুবলের শ্বশুর শাশুড়ি; জামাইকে সচেতন করে দিতে গিয়ে সুবলের তরফের কোনরূপ হৃদয়
অনুকূলতা না দেখে; বশীকরণ কবজে বশীভূত করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে মেয়েকে পাঠাল শ্বশুর বাড়ি।

সন্তান সম্ভবা সবিতা রাতে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়েছিল সুবলের পায়ে। সুবল দুই হাতে সবিতার মুখখানা তুলে ধরে বলেছিল;  -কি হলো, ঘোষদের বউ বুঝি নতুন কোন গয়না গড়িয়েছে? নাকি বেনারসি শাড়ি কিনেছে?  তোমারও চাই?
সুবল জানে সবিতার আবদারগুলোর আদায়ের প্রক্রিয়া।
সবিতা নাকে কেঁদেছিল;
- তুমি কি আমাকে সব সময় শাড়ি আর গয়না চাইতে দেখছো?
সুবল আদুরে গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল;
-যতবারই তুমি কেঁদেছ ওই আবদারই তুমি করেছ কিনা ।
এ সংসারের নারী সংসর্গে যে বোধ জন্মেছে তা থেকে সুবল মনে মনে একটা ভাব পোষণ করে। সেটি হল; স্ত্রী লোকের চাওয়া পাওয়া খুব সীমিত । পুরুষের মতো বাড়ি গাড়ি, দেশ বিদেশ ভ্রমণ, উচ্চপদে চাকরি, প্রচুর উপার্জন এইসব কিছুতে বিশেষ কোন আগ্রহ নেই । স্বামী, সন্তান, আর সাত হাত শাড়ি, পুঁতির মালা, গুটি কয় গিলটি করা হলেও গহনা এটুকু হলেই তাদের চলে । চ্যানডোবার প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সুবল আজও জানে না চাঁদেও মহিলারা গিয়ে হাজির হয়েছে । আজকের এই টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের যুগে ভাবতেই অবাক লাগে। আসলে এ গ্রাম সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। টেলিভিশন দুটি একটি বাড়িতে আছে-তা চলে সোলারে মিটমিট করে; মোবাইল ফোন আছে তবে ঠিকঠাক টাওয়ার মেলে না। অনেকেই ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানে না। সুন্দরবনের একটি দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এই গ্রাম্য সরল মানুষগুলোর মাটির গল্প আঁকড়িয়ে যে ভালবাসার অনুক্রমণিকা ঘেঁটে খাদহীন একটি নিরেট সম্পর্কের অনুসন্ধান করছি শহরে তা মূল্যহীন তুচ্ছ। এ সম্পর্ক মিলবেও না। যা মিলবে তা দগদগে লাল ঘায়ের মত একটু মরচে পড়া নেই। কিন্তু মাটির যে প্রান্তে এখনো সভ্যতার হিংস্র ছোবল মানুষের সারল্য পবিত্রতা গ্রাস করতে পারেনি; সেখানের আঁচলা ভরে দুই ঢোক জল খেলেও বড় শান্তি পায় আজকের অস্থির কঠিন অসহিষ্ণু তৃষ্ণার্ত মানুষ । এই গল্প লিখতে গিয়ে আমি সেই শান্তি অনুভব করছি ।
অভিমানের ভঙ্গিতে সবিতা বলেছিল;
-এমন ভাব করছো যেন কত শাড়ি গয়না কিনে দিয়েছ আমায় ।
সবিতাকে পা থেকে তুলে বুকে নিয়েছিল সুবল । 
-কি করি বলো বৌদিমনি অহেতুক বিলাসিতা পছন্দ করেন না। অনেক কষ্ট করে আমরা বড় হয়েছি ........সহসা তড়িৎ পিষ্ট হবার মত সুবলের বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সবিতা ।
-বৌদিমনি--বৌদিমনি-- বৌদিমনি---আচ্ছা তুমি কি আর কিছুই জানো না। তোমার নিজের কিছু নেই। কেন ভুলে যাও তুমি বিমলের মত এ পরিবারের আর
একজন শরিক। তুমি তোমার টাকায় তোমার বউকে কিছু দিলে এতে কার আপত্তি? কিসের আপত্তি? সবকিছু বিমলের। আর তোমার ভাগে শুধু কাঁচকলা।
সবিতার রাগের আত্মপ্রকাশ সপ্তমে পৌঁছালে সুবলের কেবল চিন্তা হচ্ছিল বৌদিমনি শুনলে কি ভাববে। সবিতা রেগে গেলে মা চণ্ডী আবার মাথা ঠাণ্ডা হলে মাটির
কলসির মত শীতল। সবিতা বকেই চলেছিল; তাকে যে মন্ত্রপূত করে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়েছিল; সুবলের শ্বশুর শাশুড়ি তাতো সুবলের জানা ছিল না। সে সবিতাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিল;

-ছিঃ সবিতা এভাবে বলতে নেই। বৌদিমনি শুনলে কি ভাববে বলতো। সে তো আমার শুধু বৌঠান নয়। সে আমার মা। আর মায়ের কি কখনো ভাগ হয়।
সবিতা আরো চটে গিয়েছিল;
-বুঝবে বুঝবে। একটা তিল টুকরো সম্পত্তিও তোমার কপালে জুটবে না। হাঁদা কোথাকার। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
সহসা দরজার ওপারে কড়া নেড়ে মনিমালা হাঁক পেরেছিল;
-ছোট ঘরে আছিস!
পর্ব-৪
সুবল গিয়ে দরজা খোলে। লজ্জায় তার মুখ খানা লাল হয়ে উঠেছিল।
-"বৌদিমনি তাহলে কি সবিতার কথা শুনে ফেলেছে ।"
এই আশঙ্কায় ভুগছিল যখন সুবল। মনিমালা ঘরে ঢুকে বলল;-
-হ্যাঁরে ছোট....! হারুর মায়ের কাছে তুই সিন্ধুকের চাবিটা চেয়েছিস ?
সবিতার জিব আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল । আড়ষ্ট জিবটাকে ভেতরের সব শক্তি দিয়ে চালিত করার চেষ্টা করলেও সে একটু তুতলে ছিল;
-হ্যাঁ—মানে---আমার বিয়ের জাম বাটি টা নেওয়ার জন্য। বাবাকে কাতলা মাছের মুড়ো রেঁধে পাঠানোর ইচ্ছে হল। খুব ভালবাসে খেতে । অথচ বাড়িতে একটা ভাল বাটি নেই ।
মনিমালা কপাল কুচকে বলেছিল;
-সেকি গত মাসেই তো কাঁসারির কাছ থেকে কতগুলো বড় বাটি নিলাম। সেগুলো কি হলো ?
মনিমালার কথার জবাব দিতে ইচ্ছে না করলেও; সবিতাকে উত্তরে বলতে হয়েছিল;
-সেগুলো আছে। হারুর মা ঘাটে মাজতে নিয়ে গেলো তাই আর কি ?
মনিমালার বুঝতে বাকি ছিল না আসলে সবিতা সিন্ধুকের অধিকার চাইছে । দরজার ওপারে সুবল সবিতার বাক্যালাপে প্রথমটা সে চলে যাবে স্থির করেছিল তাদের না ডেকে; কিন্তু তারপর মনে করলেন এই যথার্থ ক্লাইম্যাক্সে তার প্রবেশ না ঘটলে নাটকের ছন্দ পতন ঘটবে। মনিমালা কিছুই জানেন না; এমন একটা ভাব করে বলেছিলেন;
-শোন ছোট; হারুর মায়ের কাছে সব কিছু বলিস না। ও সারা পাড়া রটিয়ে বেড়ায়। আমাদের ঘরের কথা লোকে জানবে কেন বল ।
মনিমালার কথায় সবিতার গা জ্বালা করছিল। উপযাচক হয়ে এমন জ্ঞান না দিলেই কি নয়। কোনও ভণিতা আর না করেই সবিতা বলেছিল;
-লোকে ছিঃ ছিঃ করার মতো আমি তো কিছু বলিনি। আমি তো কেবল সিন্ধুকের চাবি টা তোমার কাছে চাইতে বলেছি দিদি ।
মনিমালা স্বাভাবিকভাবে বলেছিল;
-"সেটা তুই চাইলেই পারতিস ছোট।"
আঁচল থেকে চাবিটা খুলে সবিতার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। সবিতা দাঁড়িয়েছিল পাথরের মূর্তির মতো। সুবল সবিতার হঠাৎ উগ্র ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয়ে; আরো লজ্জায় পড়ে গিয়ে বলেছিল;
-বৌদিমনি তুমি চাবিটা নিয়ে যাও। ও ছেলেমানুষ দুম করে কি না কি বলে বসেছে; তাবলে তুমি রাগ করে চাবিটা ওর কাছে দিয়ে যাবে ।
মনিমালা আরো শীতল স্বাভাবিকভাবে বলে গিয়েছিল ;
-রাগ তো আমি করিনি সুবল। সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোদের বাড়ির ভার বয়ে চলেছি। আমার কি রেহাই নেই। তোরা বড় হয়েছিস। এবার নিজেরাই এক একটা দায়িত্ব নে না বাপু।
মনিমালা চলে যেতেই সবিতা সুবলের দিকে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল;
-ঢং—ঢং—ঢং--- ঢং দেখলে আর বাঁচি না! বৌদির কাছে একেবারে সোহাগ উথলে উঠল। অত ন্যাকামো না দেখালে চলছিল না ।
গায়ের জামাটা খুলে বিছানার উপর সজোরে ছুড়ে ফেলে রাগ প্রকাশ করে; এলো গায়ে সেদিন দুপুরে না খেয়ে নির্জন পুকুর ঘাটে একাকী বসে ছিল সুবল। এ তার ছোটবেলার অভ্যাস। কতবার ইস্কুল থেকে অংকের মাষ্টার মশাই বাড়ি বয়ে রিপোর্ট করে গিয়েছে। এ ছেলের পড়াশোনা হবে না মাথা ভর্তি গোবর ! এত বড়
দামড়া ছেলে এখনও অবধি ল.সা.গু----গ.সা.গু কষতে জানে না। বিমল দশম শ্রেণীতে উঠে গিয়েছিল আর সুবোল তখনো অষ্টম শ্রেণিতে পাছা ঘষে
চলেছে। তিরিক্ষি মেজাজে জ্বলে উঠতেন সুবলের বড়দা। গালিগালাজ তারপর বেতের লাঠির ঘা পড়তো সুবলের পিঠে।বৌদি হাউ মাউ করে ছুটে এসে হেঁশেল ফেলে সুবল কে বাঁচাত ।
সেই সব দিনগুলো তে ঠিক এমনি করে পুকুর পাড়ে এসে স্নান খাওয়া না করে বসে থাকতো সুবল
বৌদিমনি তার পেছন থেকে পা টিপে এসে বসতো পাশে। আর আলতো করে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেই সুবলের চোখের জল অভিমানে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তো চিবুক বেয়ে। মনিমালা সুবলকে বুকে টেনে নিয়ে বলতো;
-চ খাবি চ !
এই পৃথিবীতে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া অবলম্বন আবার ফিরে পেয়েও নিজের অভিমানের আভিজাত্য বজায় রাখতে আরো অপত্য স্নেহের লোভে সুবল বলতো;-না-যাও-যাব না ।
মনিমালা সুবলকে আরো জাপটিয়ে ধরত বুকে।
-এমনটা বলতে নেই! দাদা তোর ভালো চান তাই না বকেন! তুই না খেলে আমিও যে কিছু মুখে তুলতে পারবো না । আমি মরলে তুই বুঝবি কতটা ভালবাসি তোকে । বৌদিমনির মুখ চেপে ধরত সুবল। তাকে আর একটি কথাও বলতে দিত না। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতো;
-কি করবো! কত চেষ্টা করি তবুও অংকগুলো মাথায় ঢোকে না। আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ বলো? সেবার মেলা থেকে গাজনের গান একবারটি শুনে এসে তোমায় কেমন পুরোটা শুনিয়ে ছিলাম—
মনিমালা মাস্টারদের গাল পাড়তেন।
-পোড়ার মুখো মাস্টার গুলোও হয়েছে সেরকম। পুরুষ মানুষ রোদে পুড়ে ঘরে ফিরতে না ফিরতেই ওনারা নালিশ করতে হাজির হবেন।
বাৎসল্য মাখানো অপত্য স্নেহে সুবলের চোখের জল মুছে; গালে হাত বুলাতে বুলাতে মনিমালা বলতো;
-থাক তোর আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই।
এভাবেই একদিন সুবলের পড়াশোনার ইতি হয়েছিল ।


(পরের অংশ আগামী সংখ্যায় )