গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

পাঠ-প্রতিক্রিয়া - ‘এবং অস্পৃশ্য হাত’ / বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

           অনুগল্প সংকলন

‘এবং অস্পৃশ্য হাত’ / বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

    বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ৩৭টি গল্প নিয়ে ।  আকার ও প্রকরণের দিক দিয়ে গল্পগুলিকে অনুগল্পই বলবো । বাংলা সাহিত্যে গল্প বা গদ্যকাহিনীর ক্ষেত্রে অণুগল্পধারণাটি নিতান্তই নবীন । ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রীগৃহ । অভিধা থেকেই স্পষ্ট এমন গল্প আকারে ছোট হবে । কিন্তু কত ছোট তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য মিমাংসা এখনও পর্যন্ত কেউ করেছেন এমন জানা নেই । অনেকে বলেন অনুগল্পের পরিধি এক হাজার শব্দের কম হবে, আবার চিনা সাহিত্যে নাকি এমন ক্ষুদ্র অবয়বের গল্পকে বলে স্মোকলং ফিকশন, ইংরাজি সাহিত্যে ফ্ল্যাস ফিকশন নামটিও বেশ পরিচিত । অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরে এবং ওয়েব পত্রিকাগুলির সৌজন্যে অনেক অনুগল্প পড়ার সুযোগ হচ্ছে,বেশ কিছু অনুগল্পের সংকলনও বের হচ্ছে । এটা নিশিতভাবেই অভিনন্দনযোগ্য ।

প্রকরণগতভাবে ছোট গল্পের সঙ্গে অনুগল্পের খুব বেশি প্রভেদ আছে বলে আমি মনে করিনা । সার্থক ছোট গল্পের নির্মাণের যে মূলগত উপাদান নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকন্ঠা, চরম মূহুর্ত এবং লিখনশৈলীর সঙ্ঘবদ্ধতা । অণুগল্পের ক্ষেত্রেও এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । ছোট গল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথের কথায় -

...... নাহি বর্ণনার ছটা
ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ব নাহি উপদেশ ।
অন্তরে অতৃপ্ত রবে
সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ

    ছোট গল্পের মত অনুগল্পেও থাকবে না ঘটনার ঘনঘটা কিংবা বর্ণণার ছটা, থাকে না তত্ব, উপদেশ, থাকে অতৃপ্তি শেষ না হওয়ার অতৃপ্তি । তবে দুটির মধ্যে একটা মূলগত প্রভেদ থাকেই ।  গল্প তৈরি হয় কতকগুলো মুহূর্ত নিয়ে একাধিক দৃশ্যকল্পের নির্মাণ হতে পারে । কিন্তু একটি সার্থক অনুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েই গল্প শেষ ।

    এই যে পাঠকের অতৃপ্তি যা অনুগল্পের মূল বৈশিষ্ট্য, সেই প্রসঙ্গে আলোচ্য সংকলনের যে মেয়েটি একদিনগল্পটি উল্লেখ করছি । মেধা নামের বন্ধু মেয়েটিকে চিনতেন লেখক সেই স্কুল জীবন থেকেই । কবিতা লিখতো মেধা । তার সঙ্গে বন্ধুত্বে লেখক গর্বিত । তারপর  স্কুল জীবন শেষ, সময়ের সাথে দূরে সরে গেছে তারা,  মেধা কি করছে্‌ কত লিখেছে তা জানায় আগ্রহী লেখক মেধার সন্ধান পান যখন সে শুভময় মাষ্টারের বৌ । সে আর কবিতা লেখে না । মেধা নয় শুভময় মাষ্টারের বউ । সে আর কবিতা লেখে না” - এই দুটিমাত্র খন্ড বাক্যের মধ্যই কাহিনীর না বলা বহুস্তরীয় বিস্তার পাঠকের ভাবনায় আসতে পারে পাঠকের ভাবনাকে উসকে দেওয়াই অনুগল্পকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত । বিপ্লব সেই লক্ষ্যে সফল । 

      বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিপ্লব তাঁর গল্পগুলির উপকরণ সংগ্রহ করেছেন আমাদের মধ্যবিত্ত যাপনের নানান বিসঙ্গতি আর তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাত থেকে । কখনো বা কোন চেনা চরিত্র তাঁর গল্প রচনার সহায়ক হয়েছে । আমাদের চারপাশের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে আমাদের জিজ্ঞাসা, বিষন্নতা, দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, মাটিমাখা মানুষের ঘাম-গন্ধ এবং জীবনের স্বপ্নওএ সবই বিপ্লবের গল্পগুলির ভাববীজ । অগ্নিদার চোখে লেগে থাকা স্বপ্নের দাগ দেখেছেন (আবার কুড়ি বছর পরে), বৃষ্টিভেজা যমুনার ভাঙ্গা চুল্লিতে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে স্বপ্নের লিরিকশুনতে পেয়েছেন । (উড়ন্ত স্বপ্নের লিরিক)

    অনুগল্পের নির্মাণশৈলীর সারসত্য শব্দ ও ভাবনার সার্থক ব্যবহার । সংকলনের নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় লেখক সেকথা স্বীকার করেছেন, বলেছেন এখানে চরিত্র আঁকার কোন সুযোগ নেই, আছে শুধু গল্পের নির্যাস ও দীর্ঘস্থায়ী ফ্লেভারতেমনই একটি গল্পের উল্লেখ করি, গল্পের নাম স্বপ্নস্বল্পবাক মানব বিশ্বাস মানুষের লড়াই আর স্বপ্নের গল্প লিখতেন । তাঁর বুকের মধ্যে অষ্ফূট অনুচ্চারিত শব্দের জমাটবাঁধা স্তর লেখক অনুভব করেছেন । মানবের বুক পকেটে একটা টুকরো কাগজ থাকতো । ঘরে আগুন লাগলো, আগুনে পুড়ে মানবের প্রাণ গেল কিন্তু সেই টুলরো কাগজটাকে আপ্রাণ চেষ্টা করে বাঁচিয়ে রাখলেন । টুকরো কাগজটায় একটি মাত্র শব্দ লেখা ছিল স্বপ্ন। গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়েছে  অনুগল্পে চরিত্র আঁকার কোন সুযোগ নেই এই কথাটার সবটা সত্য নয় । ভাবনার গাঁথুনি আর শব্দের মোচড়ে একট মাত্র বাক্যেই তা আঁকা যায় বৈকি ! বিপ্লবের গল্পগুলি আমাদের জীবনবাদী ভাবনাকে উসকে দিয়েছে ।  অবয়ব ক্ষুদ্র, কিন্তু পাঠ-সুখের রেশ থেকে যাবে দীর্ঘ সময় ।

    মেঘ অদিতি কৃত শোভন প্রচ্ছদে কেতকীপ্রকাশিত সংকলনটি পাঠক সমাদর পাবে বলেই আমার বিশ্বাস । ৪৮ পৃষ্ঠার অনুগল্প সংকলনটির দাম সত্তর টাকা ।