গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
তাপসকিরণ রায়
ধারাবাহিক
ইন্দোর হ্যান্টেড কাহিনী—১৯
রূপমতী ও
বাজবাহাদুর কথা
রূপমতী মহলে
আজও গভীর রাতে শোনা
যায় রাগরাগিণীর আলাপ। রানী রূপমতীর সুরেলা কণ্ঠ
বাতাসের শন শন শব্দের
মাঝে মাঝে ভেসে আসে। শোনা যায়, প্রেমিক-প্রেমিকার গোপন বার্তা-সংলাপ।
মহলে মহলে দেওয়ালে
দেওয়ালে তা ধাক্কা খেয়ে
বাতাসে সে সব শাব্দিক
আভাস আমাদের স্মরণ করিয়ে
দেয় আজ থেকে দু
হাজার বছরেরও আগের অমর
প্রেম গাঁথাকে।
মালয়ার
শেষ স্বাধীন আফগান সুলতান ছিলেন বাজ বাহাদুর। বাজবাহাদুর খানের জাহাজ মহল। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরেরই অংশ
বিশেষ এই মাণ্ড। এখানকার জাহাজ মহলে
তখন রাজ করছেন বাজ
বাহাদুর খান।
সমতল থেকে প্রায় দু হাজার ঊন আশি ফুট ওপরে বিন্ধ্যাচল
পর্বতের গায়ে তৈরি হয়েছে
এই প্রাসাদ মহল। বাজ বাহাদুর ছিলেন
গুণী-জ্ঞানী ও সঙ্গীতের
পূজারী। সে
সময়ে তিনি ছিলেন একাধারে
শাসক ও কলাকার।
পালোয়ার নামক
জাগার এক কৃষক কন্যা
ছিলেন রূপমতী। রূপমতী ,
আসলেই রূপমতী ছিলেন।
তাঁর রূপ ও ঈশ্বর
প্রদত্ত গানের গলা ছিল। সঙ্গীত রাগরাগিণীতে তিনি
ছিলেন পারঙ্গম।
রূপমতী সুন্দর মনোজ্ঞ কবিতা
লিখতে পারতেন।
কথিত আছে যে রূপমতির
কাছে তানসেন এসেছিলেন গান
শুনতে আর
সেখানে তানসেন তাঁর রাগ
রাগিণীতে পদ্মের ওপরে বসে
থাকা ভোমরাকে উড়িয়ে দিয়ে
ছিলেন। এবার
রূপমতী তার রাগালাপে সেই
ভোমরাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন
পদ্মের ওপর।
এভাবে তানসেন নাকি রূপমতির
কাছে হার মেনে ছিলেন।
বাজ বাহাদুর
রূপমতীর রূপে ও
গানে মোহিত হলেন। ওঁরা পরস্পরের প্রতি
আকৃষ্ট হলেন।
রূপমতী শেষে তাঁর বাবার
অমতেই বিবাহ করলেন বাজ
বাহাদুরকে। তবে
বিবাহ অনুষ্ঠিত হল হিন্দু
ও মুসলিম উভয় রীতি নিয়ম মেনে। বিবাহের পর রূপমতী
হলেন, রানী রূপমতী।
এবার রাজা
রানী প্রেমের অতলে ডুব দিলেন। দৈহিক প্রেম
এখানে বড় কথা ছিল না। কামজ মহব্বত থেকে
দূরে ওরা একজন আরেক
জনের প্রতি ছিলেন আকর্ষিত। রাগ-রাগিণী, সুর
সঙ্গীতের এক মহল তৈরি
হয়ে গেল।
রূপমতী গান গেয়ে যান,
আর সুলতান তা অন্তর্মন
দিয়ে শুনতে থাকেন। গভীর ভালবাসা রাগ-আলাপে লালায়িত হয়ে
ওঠে। এক
সময় ওদের মধ্যান্তর হয়,
স্তব্ধতার মাঝখান
থেকে বাজ হয়ত ডেকে
বসেন, নূর, আমার রূপমতী
!
--বলুন আলমপনা ! রূপমতীর
গভীর গলার খাঁজ থেকে
সে কথাও যেন কোন
সঙ্গীত লহরী হয়ে বেজে
ওঠে আলমপনার কানে ও
মনে। ভালবাসার
অগাধ প্রাণ ওঁদের মনে
ও শরীরে বয়ে যায়। শরীরের গভীর থেকে
বয়ে আসে সে ভাব,
কিন্তু তা শারীরিক নয়। বাজ তাকিয়ে থাকেন
রূপমতীর দিকে।
কিছু যেন তাদের বলতে
হয় না আঁখি বলে
দেয় মনের ভাষা, মুখমণ্ডল
আয়না হয়ে ধরে নেয়
পরস্পরের মন। ভালবাসি, ভালবাসি, মুহব্বত,
মুহব্বত এই একটা কথাই
যেন এই সঙ্গীত কাব্য
মহলে বিস্তার লাভ করে।
বাজ রানীর
জন্যে তৈরি করালেন রেওয়া কুণ্ড, নর্মদা নদীর কাছে তৈরি
করিয়ে দেন রূপমতী মহল। রানী যে তাঁর
ভক্তিমতী, প্রতিদিন নর্মদাকে দর্শন
না করে তিনি যে
অন্ন গ্রহণ করেন না। নদী তীর থেকে ফেরার
পথ বাজ বাহাদুরের মহলের
পাশ দিয়ে চলে গেছে। রানীর নর্মদা তীরে
যাওয়া-আসার সময় আলমপনার
চোখে তাঁর চোখ পড়ে--এ যেন নয়ন
হেরিয়া দেখিনু তোমারে’র
মতই এক দৃশ্য।
কিন্তু জীবন
অন্য কথাও বলে--শুধু
সুখ বা ভালবাসা নিয়েই
তো জীবন হয় না। তাই বুঝি একদিন
তাদের এই স্বর্গীয় ভালবাসায়
দুষ্টের ছায়াপাত ঘটল। রূপমতীর সৌন্দর্য ও
গুণের কথা তখন কে
না জানত ? তার রূপ ও
গুনের কথা স্বয়ং দিল্লীর
নবাবের কানে গিয়ে পৌঁছাল। নবাব আকবর তখন
তাঁর হারেমের শূন্যতা পূর্ণ
করতেই বোধ হয় বাজ
বাহাদুরের কাছে খত পাঠালেন,
রূপমতীকে দিল্লীর দরবারে, আমার কাছে পাঠিয়ে
দাও !
পত্র পেয়ে
ভীষণ গুস্সা হলেন বাজ
বাহাদুর, তিনি রাগের বসেই
বাদশাকে লিখে পাঠালেন, আপনি
আপনার বেগমকে আমার এখানে
পাঠিয়ে দিন।
ব্যাস, আর যায় কোথায়
? আকবর দিল্লী তথা ভারতের
নবাব, তাঁকে কিনা এমনি
স্পর্ধিত জবাব ! তিনি বাজ বাহাদুরের
ওপর ভীষণ রেগে গেলেন,
বাজ বাহাদুরকে শায়েস্তা করতে
অবিলম্বে সেনাপতি আদম খাঁকে
সসৈন্য পাঠালেন মাণ্ডতে। বাজ বাহাদুর স্বল্প
সৈন্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন
আদম খাঁর সৈন্যের ওপর। পরিণামে হার হল,
বাজ বাহাদুর বন্দী হলেন।
আদম খাঁ
এবার সুলতানের মহলে এসে
খোঁজ করলেন, রানী রূপমতির। রূপমতী তখন নিজের
রূপমহলে বসে আছেন। বাজের কথা ভেবে
ভেবে তিনি অস্থির হচ্ছেন। তার ওপর আদম
খাঁর কথা শুনে তিনি
ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। না তিনি কিছুতেই
দিল্লী বাদশাহের কাছে যেতে
পারেন না। তাঁর প্রিয় ভালবাসার
বাজ বাহাদুরকে ছেড়ে তিনি
কি ভাবে চলে যেতে
পারেন ? তার সঙ্গে যে
তার মন ও অন্তরের
যোগ ! তাঁকে ছাড়া যে
রূপমতী বাঁচতে পারেন না। এদিকে আদম খাঁর
লোক রূপমতিকে নিয়ে যেতে
এলো। আর
বাঁচার কোন পথই তাঁর
সামনে ছিল না। স্বামী তখন তাঁর
বন্দী। রূপমতী
আর পারলেন না--কিছুতেই
তিনি বাজ বাহাদুরকে ছেড়ে থাকতে
পারেন না। আর হিন্দু নারীর
ধর্ম এটা নয় যে
তিনি স্বামীকে ছেড়ে পর-পুরুষের হাতে ধরা
দেবেন ! তাই তিনি মুহূর্ত
দেরী না করে নিজের
আঙুলের হীরের আংটি থেকে
খুলে নিলেন, হীরক খণ্ড
আর তা গলাধঃকরণ করে
নিলেন। তারপর
আর কি ? কিছুক্ষণ পরেই রূপমতী
মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
রূপমতির মৃত্যুর
খবর পৌঁছে গেলো দিল্লীর
বাদশা আকবরের কানে। তিনি দুঃখিত হলেন,
বাজ বাহাদুরকে বন্দিত্ব থেকে
মুক্ত করে দিলেন। বাজ বাহাদুর নিজের
মহলে এসে সব জানতে
পারলেন। জানতে
পারলেন তাঁর প্রাণের প্রিয়তমা
আর নেই, সে তার
সম্মান ও আত্মরক্ষার্থে প্রাণ
বিসর্জন দিয়েছেন।
তখন
বাজ বাহাদুর রূপমতির সমাধি
চত্বরে পাগলের মত কেঁদে
ফিরলেন তারপর একদিন তিনি
গভীর দুঃখে-বিষাদে প্রিয়তমার
সমাধির ওপর মাথা ঠুকে
ঠুকে নিজের প্রাণ দিলেন। এ মর্মান্তিক ঘটনা,
এমনি এক প্রাণ প্রতিম
ভালবাসার নির্মম পরিণতির কথা
ভেবে আকবর বাদশার মন
ব্যথিত হয়ে পড়েছিল। তিনি তাই পাশাপাশি
রূপমতীর ও বাজ বাহাদুরের
সুরম্য সমাধি গৃহ তৈরি
করিয়ে দিয়েছিলেন।
এমনি ছিল
সেই বাজ বাহাদুর আর
রূপমতির অমর প্রেম গাঁথা
! সে তো ছিল এক স্বর্গীয় প্রেম।
এই চিরন্তন প্রেমের সমাধি
ঘটেছিল আজ থেকে ২০০০
বছরেরও আগে।
কিন্তু আজও জাহাজ মহল
চত্বর কিংবা রূপমতী মহলের ভেতর
থেকে গম্বুজ দরবাজাগুলি দিয়ে
ভেসে আসে করুণ সব
রাগরাগিণীর রেশ।
রাগ-রাগিণীর সপ্তসুর লহরী এখনো
যেন সেখানকার বাতাসকে ভারী
করে রেখেছে।
কিছু কাটা কাটা সংলাপ,
কিছু গানের আলাপ কিংবা
ছন্দিত কবিতা পঙক্তি গান
হয়ে ভেসে আসে, সে
হবে রূপমতীর কণ্ঠস্বর, সে
হবে বাজ বাহাদুরের ব্যথিত
অব্যক্ত সংলাপ।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)