গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮

রুখসানা কাজল

তান্না

প্যানপেনে হলুদ আলোয় নিজের পার্স খুঁজছিলতান্নাগেল কোথায় ছাই!কাল রাতে এখানে রেখেই তো সোজা কিচেনে ঢুকে পড়েছিল সে।
কি যে হয় আজকাল মনে থাকে না কিছুই।
সামান্য টেনশন হলেই মাথাটা বিগড়ে যায়। পচা কুমড়োর মত ঢকঢক করে নড়ে ওঠে ব্রেন। সদ্য   চাক ভাঙ্গা মৌমাছির মতবোঁ বোঁ শব্দ হয় তখনতার সাথে কানের ভেতর গলা খুলে চিচিম চিচিম করে ডেকে যায় ঝিঁঝিঁ পোকার দল।
তান্না তখন হাল ছেড়ে দেয়। ধুস, যাক গে যাক। সব স্মৃতি ধুয়ে মুছে যায় যদি তো যাক গে। কি হবে এ জীবনে স্মৃতিফুলের মালা গেঁথেগেঁথে !

আসগরের আসার কথা ছিল কাল রাতে
সেকথাও একেবারে ভুল মেরে গেছিল সেভাগ্যিস  আসার আগে কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়েআসগর নিজেই ফোন করেছিল । নইলে বেচারাকেফাঁকা ঘরে একাবসে থাকতে হত তান্নার কাজ শেষে ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।
সোফার উপর জমে থাকা এক বোঝা ছাড়া কাপড় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পার্স খোঁজে তান্না।
যা বাবা এত কাপড় জমে গেছে!কবে যে বসে একটু গুছিয়ে নেবে তার সময়ও হয় না।  কাজ শেষে ঘরে ফিরে কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না ওর। গা ছেড়ে শুয়ে থাকে। টিভিটা একা একাই এবিসিডি বকে যায়। ও ঘরের ছাদ দেখে। দেওয়ালে টিকটিকি খোঁজে।নিঃসীম ফাঁকা ঘর। নিশ্ছিদ্র সুনসান। হিম হিম নীরবতা। এ একটা জীবন হলো ! ইচ্ছে মত শোও, খাও , ঘুমাও, জেগে থাকো, হেসে কেঁদে চেঁচাও কেউ এসে বলবে না, এই শুনছ এক কাপ চা বানাও তো তান্নুজান। কিম্বা, মা মা দেখো ভাইটা আমার সব রং পেন্সিল কেড়ে নিচ্ছে---

এই ত পেয়েছি! এক থোক কাপড়ের নিচ থেকে হারানো পার্সটা খুঁজে পেয়ে তাড়াতাড়ি অফিসেরবড় ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেতারপর হালকা করে দরোজা টেনে বেরিয়ে পড়ে তান্না।
আজ সানডে। এখনো শীত রয়েছে জাঁকিয়ে। সাদা শীত। যেদিকে তাকাও বরফ আর বরফ।
বিদেশের সব ভালো! কেবল এই বিচ্ছিরিশীতকালটা যেতেই চায় না।
মোটা কোটের উপরআরো একটা মোটা শালে মাথামুখজড়িয়ে কাছের বাঙ্গলাদেশি স্টোরেআসে তান্না।আসগারের প্রিয় কিছু খাবার কিনবে ও।
এটুকু রান্না করতে ওর বেশ ভাল লাগে। তবুও তো সপ্তাহ শেষে কেউ একজন ওর হাতের রান্না খেয়ে বাচ্চাদের মত খুশিতে আহা উহু করে ওঠে !
হা করে ঘুমুচ্ছে আসগর এখানকারএকটা ফিলিং স্টেশনে কাজ করে ও
পরিচয় হয়েছিল সেখানেই। বয়সে কয়েক বছরেরছোটই হবে আসগর। তাতে তান্নার কিছু যায় আসে না। তান্না জানেএই বয়সে ওর আর আসগরের শরীরেনতুন করেআর কোনো বাড়বাড়ন্ত হবে না।চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর বয়সে ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গী হয়ে সুখেই আছে গোটা বছর দশেক
তাছাড়া একাত্তরে ওর মাকে যে পাকিস্তানী সৈন্যটি রেপ করেছিল তার বয়েস ছিল বড় জোরএকুশ কি বাইশ। বয়স কম হলে বা বেড়ে গেলে পুরুষের নাকি তেমন কিছু আসে যায় না। নারীদের কি সমস্যা হয়? এই পয়তাল্লিশে তান্না অবশ্য তেমন কিছুই বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে ত সম্ভোগ সঙ্গম ছাড়াই কত দিন ওরা কাটিয়ে দেয় মহা আনন্দে।আবার কয়েকটা দিন থাকে তুমুল শরীরী। সম্পর্কের উনিশ কি বিশ কই কিছুই ত হয় না! ওদের কাছে বয়েস একটি বেচারা সংখ্যা হয়ে বয়ে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারে। 

একটা সত্যি বিয়ে আর একটা চুক্তি বিয়েতে দুজন পুরুষের সাথে দশ আর পাঁচ করে পনেরো বছর সংসার করে এই একাকি জীবনের বছর দশেক সে আসগরের সাথে থাকছে।
আসগর গুজরাটি এবং আর কখনো গুজরাটে ফিরে যেতে চায় না। কিন্তু গুজরাটের জন্যে মনের ভেতর অবিরাম কেঁদে যায়। যেমন কাঁদে তান্না।
দুজনের ভেতর ভাল সমঝোতা। বিয়ে ফিয়েতে আর আগ্রহ নেই ওদের। আসগর উইকএন্ডে চলে আসেতান্নার কাছে। দুজন দুজনের কথায়, গানে, সংসারের কাজে কর্মে, শরীর ও ঘামে ঘর খুঁজে নিয়েছে। মাঝে মাঝে হঠাত কখনো ওদের  হারানো স্বদেশও চলে আসে ক্ষণিকের উদ্ভাসে।
কোনো কোনো দিন আসগর ফোন করে গুজরাটের এক শহরে, রমেশ নামের একজনের কাছে জানতে চায়, কেম ছ মহারো গুজরাট মোটাভাই?
ওপাশে রমেশ মোটাভাই বার বার গুজরাটে ফিরে আসতে বলে আসগরকে, ফিরে আয় আসগর ভাই আমার। দাঙ্গা নেই। চুকেবুকে গেছে সব।
না না করে হাজারবার  না বললেও আসগরের চোখে মুখে ভেসে ওঠে মায়ের কোলে বসে দোল খাওয়ার আনন্দ আর খুশি। সেদিন আসগর সারাক্ষণ মাউথ অর্গানে সুর তোলে, এ যো দেশ হ্যায় তেরা, স্বদেশ হে তেরা --------
তখন কেনো যেনো তান্নার মনেও ভেসে যায় , এ মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা, দে না , আমায় দে না, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে  দে না---

তান্নার প্রথম বিয়েটা বেশ লাগসই হয়েছিল। একদিন কি যে হল। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে মিন্তি মজুর কাজ করছে পুকুর ধারেউঠোন লাল করে রোদ তাপাচ্ছে ক্ষেতের শুকনো মরিচ। লাউকুমড়োর জাংলার হাতলেবসে তিন চারটে দাঁড়কাক ক্যা ক্যা করে গলা ফাটাচ্ছে।
শাশুড়ির সাথে দুপুরের রান্না করছিল তান্না। ছেলেমেয়ে দুটো ইশকুলে। এমন সময় প্রথম স্বামি শফিক অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসে। শাশুড়িই আগে দেখে।অবাক হয়ে রান্নাঘরের দরোজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করে, অ শফিক ফিরে আসলি যে বাবা! শরীর খারাপ টারাপলাগতিছেনাকি রে বাপ ?
তান্না আলু পটল উচ্ছে তরকারি কুটছিল। বঁটি নামিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে, কি হইছে কিতোমার ? মুখটা যেনো লাল লাগতিছে ! এই যে শুনছ তুমি বসো তো আগে শরবত বানাই !  না না, আগে তুমি পানি খাও।  দাঁড়াও পানি আনতিছি এখুনি !
শফিক তান্নার দিকে রক্তচোখে তাকিয়ে থাকে। রাগে গরগরকরছে ওর সমস্ত শরীর।
তান্না গ্লাসে পানি নিয়ে শফিকের কপালে হাত দিতে যেতেই গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দেয় শফিক। তারপর আচমকা তালাক, তালাক, তালাক বাইন তালাক দিলাম তোমাকে, বলে ঘরে ঢুকে ঘটাং শব্দে দরোজা বন্ধ করে দেয়।
আম্মাগোবলে তান্না ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে।
শাশুড়ি,ননদ দেবররা ছুটে আসে। বদ্ধ দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই চুপকরতে বলে শফিককে। কিন্তু কেউ সেদিন থামাতে পারেনি শফিককে। উন্মাদের মত ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলতে থাকে শফিক,তালাক দিলাম তোমাকে।তুমি এখুনি বেরোও। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তোমার মুখ যেনো আর না দেখি!
তান্না কেঁদে আকুল হয়। সাথে শাশুড়ি ননদরাও দিশেহারা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এ কি হলো তাদের বাড়িতে। বড় দেবর সান্ত্বনা দেয়, চিন্তা করো না ভাবি। রাগের মাথায় তালাক বললেইতো আর তালাক হয়ে যায় না।
কিন্তু শফিক জানায়, সে  সজ্ঞানে সচেতনভাবে তান্নাকে তালাক দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে তা তালাকনামার কাগজেই সে লিখে দেবে।তান্নার আব্বাজিকে খবর দিয়ে পাঠিয়েছে। সে যেনো চলে  যায় তার আব্বাজির সাথে। ছেলেমেয়ে সে দেবে না। পারলে কেস করুক।
এবার হতবাক হয়ে পড়ে সবাই।

শফিক তান্নার ভেতরে খুটখাট ঝগড়া ছাড়া কখনো বড় কিছু নিয়ে তেমন মনোমালিন্য হয়নি। তান্না হাসিমুখে শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। ফলে এবাড়ির ছোট বড় সকলের কাছেই তান্না বেশ প্রিয়।
বড় ভাইয়ের কান্ডমান্ড দেখে ছোট ভাইবোনেরা অবাক আর বিরক্ত হয়। ভাবির বিরুদ্ধে তাদের কখনোই কোনো অভিযোগ ছিলনা। বরং সকলের মুশকিল আসানহিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিল  তাদের বড়ভাবি।
তান্না নিজেও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, শফিক আজ বিয়ের দশ বছরের মাথায় হঠাত কি কারণে তাকেতালাক দিলো ! কোনো কিছুই তো অজানা নয়! সবকিছু জেনে শুনেই তো শফিকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। তবে ?
একাত্তরের শান্তি কমিটির একজন চেয়ারম্যানের মেয়ে সে। কেবল সে নয় তার অন্য তিনবোনের বিয়েতেও বাবার পরিচয়ের জন্যে প্রচুর সমালোচনাহয়েছে। সব বোনকেই শ্বশুরবাড়িতে কমবেশি খোঁচা সহ্য করতে হয়। ঠাট্টার ছলে হলেও কেউ না কেউ একবার মনে করিয়ে দিয়ে যায়, ওরা রাজাকারের মেয়ে। দেশদ্রোহীর রক্ত ওদের শরীরে। তাতে রাগ করে না ওরা। বরং কমবেশি ঘৃণাই করে ওরা ওদের আব্বাজিকে।
তান্নার মনে আছে, ছোটবেলার কিছু ঘটনা। ওদের দেখলেই ছোট শহরের অনেকে চোখ ঘোঁচ করে নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করত।অনেক মুরুব্বি ছোট্ট তান্নাকে কাছে ডেকে নিয়ে কি যেন খুঁজত তান্নার মুখে।তান্না ছটফট করে ছুটে পালিয়ে আসত।এসবকিছু  জেনেই তো তান্নাকে বিয়ে করেছিলো শফিক।
তাহলে? আর কি অপরাধ আছে তার ?

মাগরিবের নামাজের পর তান্না দেখে সারিবদ্ধ কাঁঠালগাছ লাগানো রাস্তা দিয়ে তার আব্বাজি হেঁটে আসছে। ঝড়ের মত গিয়ে আছড়ে পড়ে, আব্বাজি আমার সংসার বাঁচান।আমি জিয়ারাইসাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবো না আব্বাজি!
আব্বাজি কারো সাথেই কোন কথা না বলে তান্নাকে নিয়ে চলে আসে।
তান্না ভাবে এই মুহুর্তে কিছু বলে কোন লাভ হবে না বলেই আব্বাজি চুপ থেকে তাকে নিয়ে চলে এসেছে। পরে নিশ্চয় একটা ফয়সালা হয়ে যাবে । শফিকের রাগ আর কতক্ষণ থাকবে। বাচ্চারা ইশকুল থেকে এসে কান্নাকাটি করলেই শফিক তওবা করে তাকে নিতে আসবে। কিম্বা ও বাড়ির  কাউকে পাঠাবে তাকে নিয়ে যেতে!
ব্যাপারটা ভেবে তান্নার আরো বেশি কান্না পেয়ে যায় রিকশার ভেতর সে কাঁদতে কাঁদতে ভাবে, আল্লারে শফিক কেন এরম করল? তাওবিয়ের এতবছর পরে!
কত সাধের সংসার তাদের। মুহুর্তে ভেঙ্গে চুরচুর করে দিলো শফিক।

আব্বাজি তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে দিতে মাঝে মাঝে বিশেষ একটা জায়গায় হাত রাখছিল। তান্না তখন কান্নার দমকে আমল দেয়নি। সেখানেই মাঝে মাঝে একটু গভীর চাপ দিচ্ছিল আব্বাজি।তান্না একটু চমকে গেলেও ভেবেছিল সান্ত্বনার প্রকাশ হয়তবা।
তার আব্বাজী কঠিন দিলের নেকপছন্দ মানুষ। এখনো তার দিল জুড়ে পাকিস্তানের খোয়াব খেলা করে। এখনো সে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানি দিলের লোকদের সাথে। নাছারা ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। থাকত পাকিস্তান।আহা, সব কিছু কেমন জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ ছিল তখন। আব্বাজি এখনো এসব নিয়ে আফসোস করে। অন্য কিছু নিয়ে আব্বাজি ভাবে না। একশভাগ খারাপ মানুষ তিনি তবে মেয়েমানুষ দেখলে নাউজুবিল্লাহবলে সরে আসে সাত হাত দূরে
কিন্তুমাঝরাতেযখন সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে অপরিসীম কামনায় জড়িয়ে ধরে কাঁধে গলায় চুমু খায় তখনঅবাক বিস্ময়ে আঁতকে ওঠে তান্না, আব্বাজি ছাড়েন। কি করছেন কি আপনি!
মিটমিটে আলোয় আব্বাজির কামনা মদির চোখ দেখে চমকে উঠেছিল তান্না, আব্বাজি আমি তান্না। আপনার মেয়ে।
শান্তি কমিটির ভূতপূর্ব চেয়াম্যান হিসিয়ে উঠেছিল সাথে সাথে, আব্বা কিসের আবব্বা। কার আব্বা।আমি তোর মত নাজায়েজ সন্তানের বাপ না বুঝলি।
লুঙ্গির গিঁট খুলে তান্নাকে বিছানায় ঠেলে দিয়ে লম্পট বুড়ো বলেছিল, শুয়ে পড় কথা না বলে।
দু হাতে ধাক্কা দিয়ে জ্বলে উঠেছিল তান্না। উদ্যত লিঙ্গধারী বাবাকে জানোয়ার দেখা চোখে একপলক দেখেএকাত্তরে হিন্দু বাড়ি থেকে লুটে আনা কাঁসার জগ তুলে নিয়েছিল হাতে, আপনি সত্যিই একটা খবিস। জানোয়ার। মিথ্যাকথার মা বাপ। চলে যান এখুনি।নইলে মাথা ভেঙ্গেগুঁড়ো দেব আপনার।
ছাড়া লুঙ্গি কোমরে জড়াতে জড়াতে ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান অপরিসীম তাচ্ছিল্যে থুথু ফেলে হেসে উঠেছিল, যা তোর আম্মার কাছে যা। শুনে আয় কিভাবে তোর জন্ম হয়েছে হারামজাদি। শফিক কি তোরে এমনি এমনি তালাক দেছে নাকি! সব সত্যি আমি বলে দিছি শফিককে। দেখি তুই কই যাস্‌।

শরীরের এক পাশ প্যারালাইজড শিক্ষিকা মায়ের পাশে বসে আকুল হয়ে কাঁদে তান্না, আম্মা আমি কে আম্মা? আব্বাজিত অমানুষেরও অধম আম্মা। এখন কি করব আমি ? কোথায় যাব ?
খাদিজা বেগম নিজেও কেঁদে ভাসান। কি বলবেন তিনি মেয়েকে ?শুধু মুখটা মনে আছে তার। অল্প বয়েসি একজন সৈন্য। বত্রিশ বছরের খাদিজা বেগমকে টেনে হিঁচড়ে শুইয়ে ফেলেছিল গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেসের ঘরে। যুদ্ধের জন্যে প্রায় ফাঁকাইশকুলে খাদিজা বেগম, হেডমিস্ট্রেসসহ তাদের একজন বান্ধবি গল্প করছিল সেদিন। একাধিক সন্তানের মা ছিল তারা। নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ করে অল্প সন্তানের সুখি পরিবার ছিল তাদের প্রত্যেকের।প্রত্যেকের স্বামি ছিল কৃতবিদ এবং কমবেশি পাকিস্তান ভক্ত।
খাদিজা বেগম সেই সদ্য তরুণ সৈন্যটিকে ভয় দেখিয়েছিলআল্লা রাসুলের। যখন আল্লা রাসূল ফেল মেরে গেল জানোয়ারটার কাছে, তখন শহরের শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান স্বামীর কথা বলে ভয় দেখালে সৈন্যটি আরো মজা পেয়ে জাপটে ধরেছিল তাকে। বাইশ কি তেইশ বছরের এক সৈন্য। সঙ্গমে খুব পারঙ্গম নয় তেমন। অভ্যস্ত খাদিজা বেগমের তেমন কষ্ট হয়নি। কেবল ধর্ষণ  শেষে জানোয়ারটা যখনতার গায়ে মুখে পেশাব করে ছিটিয়ে দিচ্ছিল আর তার রাজাকার স্বামির নাম করে হাসছিল, খুবঘেন্না লেগেছিল মনে।
তান্না সেই ঘেন্নার ফসল।

শফিকের সাথে আপোসে তালাক হয়ে গেছিল তান্নার। নিজের বিড়ম্বিত জীবনে ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে নিতে চায়নি ও। শফিক খুব ভালো বাবা। ভালো মানুষ। তাছাড়া একটি অটুট পরিবারের স্নেহ আদর, আশ্রয় প্রশ্রয় আর পরিচয়ে ছেলেমেয়েরা আছে, তাইথাকুক। বুকের ভেতর কিছু অভিমান চেপে সে শফিককে ক্ষমা করে  দিয়েছে
 তাছাড়া তান্না আরো বুঝতে পেরেছিল, ও দূরে সরে না গেলে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, পাকিস্তানের পা চাটা রাজাকারটা ওর ছেলেমেয়েদের জীবনটাও তামা তামা করে ফেলবে। তাই ধর্ষিতা মায়ের সাহায্যে এক দূর সম্পর্কের মামা চুক্তি বিয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে আসে কানাডা।
তান্না এখন কানাডার নাগরিক।

বাংলাদেশি দোকানের ভারতীয় বাঙালী সেলসগার্ল জয় বাংলা বলে স্বাগত জানায় তান্নাকে।  ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ চলছে। তান্নার মনেই ছিলনা ভাষা শহিদের মাস চলে এসেছে। এরপরেই চলে আসবে সেই মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল মাস। রক্তাক্ত মার্চ। ছোট ছোট লাল সবুজ পতাকা আর কালো পতাকায় ভরে গেছে দোকান। লাল সাদা শাপলা ফুল হাতে গ্রামের দুরন্ত বালক বালিকার ছবি হাসছে দেয়ালে জুড়ে। ছবির শহিদ মিনার বুক ভাঙ্গা বেদনা নিয়ে তাকিয়ে আছে তান্নার দিকে।
অনেকগুলো পতাকা কিনে নেয়সে।
সন্ধ্যায় মোমের আলোয় লালসবুজ রঙ কালোতে মিলেমিশেঅদ্ভুত মায়াবি দেখায়। চেনা চেনা মায়াবীথি। লাউমাচার নিচে রক্তজবার বনে সন্ধ্যা নামলে শফিক ঘরে ফিরে আসত। কি যে এক হাসি হাসত সে !
মাউথ অর্গানে সুর তোলে আসগর, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী , মি কি ভুলিতে পারি, আমি কি --তান্না কাঁদে। মনে মনে। কেঁদে কেঁদে গাঙপাখির গলে যায়, আমি কি ভুলিতে পারি--- 
ওদের কারোর কোন স্বদেশ নাই। স্বজন নাই। দুজনের কেউই পাখি নয় অথচ ঘর নাই, মাটি নাই,‌ বৃক্ষ নাই, জল নাই, কেবল আছে উড়াল উড়াল !এ বন তো সে অরণ্যে, এ বৃক্ষ তো সে এক অন্য লতাঝোপে, জলে, স্থলে, আকাশে,
পৃথিবীর কোলে পিঠে হাতে, ওরা পরমানুষ। বৃক্ষে যেমন ঝুলে থাকে পরগাছা। অলেপ্পেয় প্যারাসাইট!